নাটকে দুই হাজার বছরের গড়ে ওঠার গল্প

শিল্পকলা একাডেমির মাঠে মহাস্থান নাটকের মহড়া
শিল্পকলা একাডেমির মাঠে মহাস্থান নাটকের মহড়া

‘টিম মহাস্থান, সবাই মাঠের মাঝখানে আসুন!’

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মাঠ থেকে কথাটি কানে এল। বসে ছিলাম জাতীয় নাট্যশালায় করিডরে। আওয়াজের সূত্র ধরে মাঠের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখা গেল একদল নাট্যকর্মীকে। মাঠের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। একদল লাঠিখেলায় ব্যস্ত। কেউ নাচের মুদ্রা বুঝে নিচ্ছেন সহশিল্পীর কাছ থেকে। কেউ সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সবুজ মাঠে। ঘোষণা শুনে সবাই মাঠের মাঝখানে এসে নির্দেশককে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে দাঁড়ালেন।

তাঁরা ঢাকার বিভিন্ন নাটকের দলে কাজ করেন। এখানে এসেছেন শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনায় নতুন নাটকের মহড়ায়। নাটকের নাম মহাস্থান।

এক পাশে বসে ছিলেন এ নাটকের নির্দেশক লিয়াকত আলী। শব্দযন্ত্রের সাহায্যে চলছে নির্দেশনা, কথাবার্তা। শিল্পীদেরও অনেকের কাছে শব্দযন্ত্র। কথাবার্তা, নাটকের সংলাপ বিনিময় চলছে সেটার মাধ্যমেই।

এত বড় পরিসর নিয়ে খোলা চত্বরে নাটকের মহড়া হতে আগে দেখা যায়নি। নির্দেশক জানালেন, নাটকটির প্রদর্শনী হবে বগুড়ার মহাস্থানগড়ের বাসু বিহারে। ৩০ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে হবে এ প্রদর্শনী। মহড়ায় সেই আবহ আনতে এ মাঠ বেছে নেওয়া হয়েছে, ২০ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে প্রতি সন্ধ্যায় জমজমাট শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। মহড়া দেখতে আসা উৎসুক লোকজনও বেশ। শনিবার সন্ধ্যার পর পূর্ণাঙ্গ নাটকের মহড়া (রান থ্রো) হয়। কত কী দেখা গেল সেখানে! শিকারের আনন্দে নৃত্যরত আদিম মানুষ। একের পর এক যুগের উপস্থাপন দেখা যায় অভিনয়, গানে, নৃত্যে ও বর্ণনায়। আড়াই হাজার বছর আগের ইতিহাস থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এসে গল্পটা শেষ হয় সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ কবিতাপাঠের মধ্য দিয়ে। নেপথ্য থেকে একজন পাঠ করতে থাকেন, ‘আমি জন্মেছি বাংলায়/আমি বাংলায় কথা বলি/আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি...।’ কবিতাটা শুনে মনে হলো, আরে এতক্ষণ তো এটাই দেখলাম! যেন কবিতার মধ্যেও গল্পটা আছে।

২৩ মার্চ পর্যন্ত মহড়ায় বিরতি। তাই শনিবার রাত ১০টায় মহড়া শেষ করে শিল্পীদের ডেকে বিরতির সময়টাতে করণীয় (হোমওয়ার্ক) বুঝিয়ে দিলেন নির্দেশক। দরদর করে ঘামছিলেন শিল্পীরা। বুঝতে বাকি নেই, বিশাল জায়গাজুড়ে মহড়ায় শিল্পীদের কায়িক শ্রমটাও বেশ হচ্ছে।

কী হতে যাচ্ছে এ নাটকে-এ প্রসঙ্গে কথা হলো শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলীর সঙ্গে। প্রথমে তিনি ইতিহাসের দরজায় কড়া নাড়লেন। ইতিহাস, পুরাণ, লোকশ্রুতি, কিংবদন্তি মিলেমিশে গড়ে উঠেছে এ নাটকের আখ্যান। বাংলার যে রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি গর্ব করার মতো সাংস্কৃতিক ইতিহাসও আছে, তা-ই ফুটে উঠবে নাটকে।’

সেলিম মোজাহারের লেখা দুই ঘণ্টাব্যাপ্তির প্রযোজনাটির সংগীত পরিকল্পনা করেছেন কমল খালিদ। তিনি জানালেন, নাটকের বিভিন্ন পর্যায়ে আদিম, বৈদিক, রামায়ণ থেকে শুরু করে কালিদাস, চর্যাপদ, পঞ্চকবি, লালনের বাণী ও সুরের ব্যবহার করা হয়েছে। দুর্লভ ও ব্যতিক্রমী কিছু বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।

ঢাকার ৬০ জন এবং বগুড়ার ১০০ জন অভিনয়শিল্পী এবং ঢাকার ৩০ জন, বগুড়ার ৭০ জন নৃত্যশিল্পী অংশ নিচ্ছেন এ নাটকে। নাটকটির প্রযোজনা সমন্বয়কারী আলি আহমেদ জানালেন, গেল বছরের ৯ জুন নাটকের জন্য শিল্পী নির্বাচন চূড়ান্ত হয়। সেদিনই মহড়া শুরু হয়। প্রথমে একাডেমির মহড়াকক্ষে এবং বিগত কয়েক দিন মাঠে মহড়া চলছে। নন্দন মঞ্চের সামনে খোলা জায়গাটিকে বাসু বিহারের আদল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন নির্দেশক।

আগামী এপ্রিল মাসের ৬ ও ৭ তারিখে বগুড়ার বাসু বিহারে প্রযোজনাটির দুই দিনের প্রদর্শনী করার পরিকল্পনা আছে।