ফিরে দেখা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জেলখানা মোড়ের কিছু দূরে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে লাঞ্চবক্স হাতে জেল গেটের দিকে যাচ্ছিল জেবা। সদ্যবিবাহিত শুভ সস্ত্রীক কিছু শপিং শেষে বাসায় ফিরছে। জেবাকে দেখামাত্র গাড়ি থামিয়ে সে ডাক দেয়।

—এই জেবা।
কোনো জবাব না দিয়েই জেবা কাছে এল।
—কেমন আছ। কোথায় যাচ্ছ। সবাই ভালো তো। কেমন যাচ্ছে সব।
শুভ এমন বেশ কয়েকটা সৌজন্যসুলভ প্রশ্ন করলেও জেবা বরাবরই নীরব। শুভ গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালে জেবা ইঙ্গিত করে বলল, তোর স্ত্রী?
শুভ স্মিতহাস্যে বলল, হ্যাঁ, এই তো এক মাস হতে চলল। ওর নাম শিলা। ইয়ে, তুই নাম ধরেই ডাকিস। অনেক ছোট। অনার্স ফাইনাল দিল এবার।
—ও, তাহলে তো আমাদের অনেক ছোট।
—হ্যাঁ, জেবা তুই তো জানিস, খুব বেশি ম্যচিউরড মেয়ের সাথে আমি আবার কুলায়ে উঠতে পারি না। আমাকে দেখতেই কেবল মনে হয় অনেক বড় হয়ে গেছি। আসলে ভেতরটা একেবারে শিশু। আর ওই আগের মতোই ভিতু। ওই যে?
ছাত্রজীবনের দুই বন্ধু-বান্ধবী এই ‘ওই’ সর্বনামে কী ইঙ্গিত করেছে, তৃতীয় মানুষটি বুঝল না কিছুই। কেবল বোবা চোখে চেয়েই রইল।
শুভর কথার কোনো জবাব না দিয়ে গাড়িতে বসা শিলার দিকে চেয়ে জেবা বলল, কেমন আছ?
গাড়ি থেকে নেমে শুভর পাশে দাঁড়িয়ে শিলা বলল, জি ভালো। কেমন আছেন?
শিলাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জেবা গলা থেকে ঝলমলে চেইনটা খুলে শিলার গলায় পরিয়ে দিয়ে বলল, শিলা, তুমি সুখেই থাকবে। শুভ কামনা রইল। তোমরা ভালো থাক।
—এ কী! শুভ আর শিলা দুজনেই বাক্যহারা। অদ্ভুত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।
—এই জেবা! কি করছিস এসব?
—হ্যাঁ করছি। কী সুন্দর! টুকটুকে একটা মেয়ে। ইচ্ছে করছে সব দিয়ে দিই। বিয়ে করলি জানতেই পেলাম না।
শুভ এবার আরও বেশি অবাক হলো।
—জানলেই কি তুই আসতিস? যে অভিমান তোর।
আনমনা চোখদুটো স্থির করে শুভর দিকে চেয়ে জেবা বলল, অভিমান? তাই না?
দুজনের এ দৃষ্টি বিনিময়ের ভেতর দিয়ে প্রায় সাত বছর আগেকার একটা স্মৃতি মেঘলা আকাশে বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলক দিয়ে গেল।
সেবার থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার আগে আগে। শুভ আর জেবার মন বিনিময় বন্ধুবান্ধবীর পর্যায় অতিক্রম করে আরও একটু অগ্রসর হতে শুরু করেছে কেবল। সেদিন ক্লাস শেষে বের হয়ে তারা দুজনে সদর রাস্তার ফুটপাত ধরে বাসায় যাচ্ছিল। দুপুরের পরপর। রাস্তায় লোকজন তেমন ছিল না।
কিছুদূর এগিয়ে যেতেই দেখা গেল তিনটা ছেলে তাদের দিকেই আসছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের একজন হঠাৎ সজোরে টান দিয়ে জেবার ওড়নাটি নিয়ে নেয়। চোখের পলকে কী থেকে কী ঘটে গেল! বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ।
—এই শুভ! ওই নীল টি শার্ট পরা ছেলেটা আমার ওড়না নিয়ে গেছে।
—ওরে সর্বনাশ! আচ্ছা আয়। এখুনি তোকে ওড়না কিনে দেব।
—কি! তোর সামনে আমাকে এভাবে উলঙ্গ করে ফেলল। তুই ওদের কিছুই বলবি না! আমাকে ওড়না কিনে দিবি? কেন? আমি কিনতে পারি না?
—জেবা, হাত জোর করছি। সিনক্রিয়েট করে কিছু হবে না। তুই বইয়ের ব্যাগটা দিয়ে বুকটা ঢেকে নে। চল, সামনেই কাপড়ের দোকান।
—তার মানে তুই ওদের কিছুই বলবি না!
—না, ওদের সাথে আমি কুলায়ে উঠব কি করে?
একটা গরম নিশ্বাস ছেড়ে জেবা বলল, ও আচ্ছা। এই যদি হয় অবস্থা। তোর কাছে আর আমার জীবনের নিরাপত্তা কি?
—না রে ভাই। আমার এত সাহস নেই যে, ওই তিন বখাটের সাথে মারামারি করব।
—ঠিক আছে, বুঝতে পারছি।
এইটুকু বলেই জেবা দ্রুত রাস্তা পার হয়ে অন্যদিকে চলে যায়।
তারপর থেকে শুভর সঙ্গে জেবার আচার আচরণ ছিল অচেনা পথিকের মতো। তারা দুজনে পরিচয় তো দূরের কথা, কখনো দেখাই যেন হয়নি। বিষয়টা বুঝতে পেরে শুভ নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এভাবেই একদিন মাস্টার্স শেষ হয়। তারপর দীর্ঘ পাঁচ বছর কেটে গেছে। আজ হলো দেখা।
—একটা সরকারি কলেজে লেকচারার পদে জয়েন করেছিস।
—হ্যাঁ, ঠিক তাই। জেবা, তুই আমার সম্পর্কে এত কিছু জানিস?
—হু, জানি। বছর খানিকের মধ্যেই সুন্দরী বউকে নিয়ে কোনো ফার্স্ট ওয়ার্ড কান্ট্রিতে স্থায়ী হবি।
—স্থায়ী হব বললেই কী আর হয়। বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেখি কী হয়। ইউকে, ইউএসএ বা অস্ট্রেলিয়া। পিএইচডিটা কমপ্লিট করব। দেখি, সেখানেই সুবিধা করতে পারি।
—দেখবি একদিন সব হয়েও গেছে। তুই পারবি। এই বলে সহজ হাসিতে শিলার দিকে তাকাল।
শিলা বলল, আপা, বাড়িয়ে বলছেন মনে হয়। আপনি আমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর।
—আরে রাখ তোমার সুন্দর। কী আর হলো তাতে।
এবার তিনজনেই নীরব।
মিনিট খানিক পর শুভকে লক্ষ্য করে জেবা বলল, তিনটা ছেলের ওই যে ঘটনাটা?
—বুঝতে পারছি। হ্যাঁ, বল।
—ছাত্রনেতা আমানকে চিনতিস?
কিছুক্ষণ ভেবে শুভ বলল, ওসবের সাথে জড়িত ছিলাম তো। তবে নাম শুনেছি। আমাদের অনেক সিনিয়র ছিল। তাই না?
—হ্যাঁ, ঠিক তাই। সেদিন তোর সাথে রাগ করে আমানের বাসায় যাই। ওকে ঘটনাটা বললে ওই দিন রাতেই তিনটাকে ধরে একেবারে সাইজ করে ফেলে। ওর সাথে শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। মাসখানেকের মধ্যেই গোপনে বিয়ে। বাবা মায়ে জানাজানি হয় অনেক পরে। এই লাইনে সবার ভাগ্য তো আর এক রকম হয় না।
শুভ কেমন ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেল যেন। কী যেন বলতে গিয়েও বারবার আটকে যাচ্ছে।
শিলা বলল, আপা। চলেন আমাদের বাসায়।
—শিলা, কষ্ট নিয়ো না। তোমাদের বাসায় কোনো দিনও যাব না। জীবনে কিছু কিছু ভুলের প্রায়শ্চিত্তের মাঝেও লুকিয়ে থাকে শান্তির ঘ্রাণ। তোমরা ভালো থেকো।
শুভ হঠাৎ সচেতন হয়ে বলল, এই জেবা! তুই এসব খাবার টাবার নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?
দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে জেবা বলে, যাব আর কোথায়। মামলা তো বেশ কয়েকটা। এর মধ্যে একটা অস্ত্র মামলার রায়ে আমানের দশ বছরের সাজা হয়েছে। এরই মধ্যে সরকারও বদলে যায়। কিছু আর করা গেল না। তিন বছর কেটে গেছে অবশ্য।
শুভ কী যেন বলতে চেয়েছিল। সে সুযোগ আর না দিয়ে জেবা দ্রুত কারা-ফটকের দিকে হাঁটতে লাগল।

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>