চিন্তা-উদ্দীপক নাট্য প্রযোজনা

পাঁজরে চন্দ্রবান নাটকের দৃশ্য
পাঁজরে চন্দ্রবান নাটকের দৃশ্য

সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স ডিপার্টমেন্ট-এর পাঁজরে চন্দ্রবান নাট্য প্রযোজনাটি দেখেছি। এই নাট্য প্রযোজনাটির অন্তর্নিহিত বক্তব্য ও আঙ্গিক আমাকে ভাবিয়েছে। যেকোনো শিল্প সৃজন; চারুকলা হোক, কি কৃত্য হোক, এই শিল্প মাধ্যমগুলোর প্রথম কাজ হলো দর্শক-শ্রোতার মনস্কতা আদায় করে নিয়ে তাকে অনিত্যের দিগ্‌দর্শন করানো এবং পরিশেষে ভাবনার জগতে ঢেউ তোলা। সেই কাজটি যথাযথভাবে পাঁজরে চন্দ্রবান নাট্য প্রযোজনাটি করতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রযোজনার সার্থকতা চিহ্নিত করা যায় এই ভাবে যে প্রযোজনাটি দর্শক-হৃদয়ে ঢেউ এবং করোটিতে টঙ্কার ধ্বনি তুলতে পেরেছে।

এই নাট্য দর্শন সুবাদে একটি বিষয় মনে পড়ে গেল। ম্যাক্সিকান কবি এবং কূটনৈতিক, অক্টাভিও পাজ একটি বই লিখেছেন—ইন লাইট অব ইন্ডিয়া। তিনি ভারতে রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং ১৯৮১ সালে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ভারতে তাঁর একটি অভিজ্ঞতা হয়, যখন তিনি একবার দিল্লিতে কোনো এক মায়িজির (দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন নারী) কাছে একটি উপদেশের জন্য তাঁর গৃহে যান, সঙ্গে ছিলেন তাঁর বন্ধু বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সুব্রামনিয়াম। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মায়িজি অক্টাভিও পাজের দিকে একটি আপেল ছুড়ে মারলেন; পাজ লুফে নিলেন। পাজ পরে লিখেছিলেন, এই আপেল ছোড়া ও লুফে নেওয়াটা তাঁর কাছে মনে হয়েছিল মায়িজি তাঁকে এই শিক্ষা দিয়েছিলেন—জীবন হচ্ছে এক খেলা। পাঁজরে চন্দ্রবান নাট্য প্রযোজনায় ব্যবহৃত মস্ত বড় বলটি ও বলগুলো দেখে আমার মনে হয়েছে যে পৃথিবী হচ্ছে খেলার মাঠ আর জীবনটা হচ্ছে মস্ত বড় এক খেলা।

আমি নিম্নোক্তভাবে নাটকটি সম্পর্কে আমার অনুভব ব্যক্ত করছি:

নাটকটির ব্যাপ্তিকাল মাত্র ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। দৈহিক ও বাচনিক অভিনয়ের সুসমন্বয় প্রযোজনাটি দর্শকদের কখনো অন্যমনস্ক হতে দেয়নি, যদিও চিরাচরিত কোনো কাহিনি বা গল্প নেই নাটকটিতে। কিছুটা ‘রিচুয়ালিস্টিক’ থিয়েটারের আদলে প্রযোজনাটি গাঁথা হয়েছে। পিটার ব্রুকের কথা মনে পড়ছিল বাচনিক ও দৈহিক অভিনয় নাটকের সুসমন্বয় ঘটানো আমাদের মঞ্চে খুব একটা দৃষ্টিগোচর হয় না।

প্রত্যেক অভিনেতা নিজ নিজ চরিত্রে সু-অভিনয় করেছেন, তবে উম্মে হানাসহ অন্য দুই নারী চরিত্রের দৈহিক ও বাচিক অভিনয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমার মনে হয়েছে, আর বেশি দেরি নেই যখন দেখব মেয়েরা একদিন খেলাধুলায়, ফিল্ড ও ট্র্যাক ইভেন্টে পুরুষদের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকের নন্দিনীর সংলাপ মনে পড়ল—‘আমি নারী বলে আমাকে ভয় কোরো না! বিদ্যুৎ শিখার হাত দিয়ে ইন্দ্র তাঁর বজ্র পাঠিয়ে দেন। আমি সেই বজ্র বয়ে এনেছি।’

নাটকের অন্তর্গত কথাগুলো আমার কাছে পৌঁছেছে এভাবে—

১. পৃথিবী কখনো শঙ্কা মুক্ত ছিল না, উদ্বাস্তু, আশ্রয়প্রার্থী, শরণার্থী এবং শরণাগতদের সমস্যা চিরকালীন। আবহমান থেকে মানবকুল এই সমস্যায় ভুগছে। এই নাট্য প্রযোজনাটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আমাদের শরণার্থীদের দুরবস্থার কথা মনে করিয়ে দিল।

২. ইতি আর নেতির লড়াই চিরকালীন। নাট্য প্রযোজনাটি মনে করিয়ে দেয় মানবজাতি সত্যিকার অর্থে সভ্যতা ও মানবতার পথে এগোয়নি। আবার মনে হয়, সভ্যতা একটি ভুল ও বিভ্রান্তিকর প্রয়োগ। হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা, হত্যা, যুদ্ধ, হানাহানি, থেকে পৃথিবী কখনো মুক্ত ছিল না, আজও নেই। পৃথিবীতে যেমন আহত, নিহত, নিখোঁজ ছিল, আজও পরিপূর্ণভাবে তা বিরাজমান। তা না হলে, বিশ্বজুড়ে এত বড় বড় সভ্যতার ধ্বংস আমাদের দেখতে হতো না। মানুষ পাপাত্মা ও পুণ্যাত্মা সংযোগে তৈরি কিন্তু বেশির ভাগ সময় পাপাত্মারই জয় লাভ হয়। বর্তমান বিশ্বে আরও যোগ হয়েছে, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মত ভয়ংকর প্রবণতাসমূহ। পাঁজরে চন্দ্রবান নাট্য প্রযোজনাটি আংশিকভাবে হলেও এ বিষয়গুলো মনে করিয়ে দেয়।

স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো, নাটকে ‘গডো’ কখনো আসেনি, তবুও আমরা তার জন্য অপেক্ষা করি। কারণ, জীবনকে প্রত্যাখ্যান করা সহজ নয়। আরেকটি সকালের সূর্যোদয়ের জন্য, সবুজ ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করি। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও আমরা জীবনের জয়গান গাই। প্রার্থনা করি আরেকটি দিনের আয়ুর জন্য। প্রথমে কিছু হতাশার বার্তা বয়ে আনলেও পাঁজরে চন্দ্রবান নাট্য প্রযোজনাটি জীবনেরই জয়গান গায়।

মানুষ কোনো যাত্রাতেই নিঃসঙ্গ থাকে না। তার চলার পথের বাঁকে বাঁকে পড়ে থাকে অসংখ্য স্মৃতি। তা ছাড়া, মানুষ তার চলার পথে চড়াই-উতরাই ভাঙার সময় একজন না একজন সঙ্গী পেয়ে যায়। পাঁজরে চন্দ্রবান নাট্য প্রযোজনাটি এই বার্তাও বয়ে আনে।

এই নাটকের তরুণ নাট্যকার নাটকের শাহমান মৈশান এবং নির্দেশক ইস্রাফিল শাহীন দুজনেই অকুণ্ঠ প্রশংসার যোগ্য, কারণ তাঁরা আমাদের দেশের নাট্য প্রযোজনায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন ঘটিয়েছেন। এই নাট্য প্রযোজনার নেপথ্য কুশলীবৃন্দ, আশিক রহমান, রুদ্র সাঁওজাল, আমিনুর আকিব, কাজী তামান্না হক ও সাইদুর রহমান সবাই প্রশংসার যোগ্য। এই নাট্য প্রযোজনায় একটি সুষ্ঠু টিম ওয়ার্ক লক্ষ করা যায়; যা একটি চমৎকার সমন্বিত কাজ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে।

জয়তু থিয়েটার।

লেখক: অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক