পায়ের তলায় পিষে মারার তাল

মর্ষকাম নাটকের দৃশ্য
মর্ষকাম নাটকের দৃশ্য

ভারতজুড়ে অষ্টম থিয়েটার অলিম্পিকসের যে এলাহি বন্দোবস্ত চলছে, তাতে বাংলাদেশের দাপট বেশ চোখে পড়ার মতো। ঢাকা তো বটেই, চট্টগ্রাম-যশোরের থিয়েটারওয়ালারাও দিল্লির বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। দিল্লির শাহি দরবার ছাড়াও আরেকটি করে শো তাঁদের সবার জন্য বরাদ্দ আছে। ভুবনেশ্বর, আগরতলা, পাটনা, গুয়াহাটি, ভোপালের মতো শহর যেখানে বাংলা না হলেও বাংলার পাড়াপড়শি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের আস্তানা পাতা আছে, সেখানে মঞ্চস্থ হচ্ছে ঈর্ষা (প্রাঙ্গণে মোর), কিনু কাহারের থেটার (প্রাচ্যনাট), ক্যালিগুলা (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ড্রামাটিকস ও ফেম স্কুল অব ডান্স ড্রামা মিউজিক), পাঁজরে চন্দ্রবান (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ), বারামখানা (থিয়েটার), মহাজনের নাও (সুবচন নাট্য সংসদ), রাই কৃষ্ণ পদাবলী (নৃত্যাঞ্চল ডান্স কোম্পানি) ইত্যাদি।

কলকাতার ভাগে বাংলাদেশের একটি নাটকই পড়েছিল। ঢাকার থিয়েটার আর্ট ইউনিটের মর্ষকাম। ৮ মার্চ সন্ধেবেলায় পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের দশাসই প্রসেনিয়াম আর্চে ঢুকতে ঢুকতে মনে হচ্ছিল ‘মর্ষকাম’ মানে কী? কথাটা তো সচরাচর চোখেকানে পড়ে না? এমনিতে ‘মর্ষ’ এই তৎসম শব্দের একটা সহজ মানে আমাদের সবারই জানা আছে। চিন্তা। যার আগে উপসর্গজুড়ে ‘বিমর্ষ’ কথাটা এসেছে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ খুলে জানা গেল, ‘মর্ষ’-র আরও দুটো মানে আছে। একটা হলো ‘ক্ষমা’, আরেকটা হলো ‘নাশন’।

কপালে ভাঁজ পড়ল। যে থিয়েটার আর্ট ইউনিট এতকাল দেশকালসম্পৃক্ত নাট্যচর্চা করে এসেছে, যাদের আমিনা সুন্দরী, কোর্ট মার্শাল, গোলাপজান, না মানুষি জমিন এক বহুবর্ণী নাট্য অভিজ্ঞতার সামনে আমাদের এনে ফেলে, তাদের নতুন নাটকের নাম শুনে বিমর্ষই হলাম বলা চলে। যে শ দুয়েক দর্শক সেদিন জমা হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের মনেই এই জিজ্ঞাসাচিহ্ন ছিল। থিয়েটার আর্ট ইউনিটের সর্দারদের কাছ থেকে যে প্রডাকশন ফোল্ডার পাওয়া গেল, তাতে দেখা গেল নাট্যকার আনিকা মাহিন একা লিখেছেন, ‘সাদা কথায় বলতে গেলে মর্ষকাম চলমান বৈশ্বিক রাজনীতির সবচেয়ে ক্ষমতাধর পরাশক্তির পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে লেখা নাটক।’ নির্দেশক রোকেয়া রফিক বেবী বলছেন, ‘মোটা দাগে বলতে গেলে এই নাটকে তিনটি বিষয় মুখ্যক্ষমতা ও আগ্রাসন, বাণিজ্য এবং যুদ্ধ।’

নাটক শুরু হচ্ছে। সেন্টারস্টেজের কাছ বরাবর একটা পর্দার মতো কিছু। একটু নজর দিতে ঠাহর হলো যে সেটা পর্দা নয়। বেশ কয়েকটি চাকা লাগানো কাঠের তক্তা খাড়া করে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড় করানো আছে। তার ওপর ওভারহেড প্রজেক্টর থেকে আলো এসে পড়ছে। ফুটে উঠছে বার কোড। তার তলায় একের পর এক গোল্লা। জিরো। কী এটা? দুনিয়াজুড়ে যে ডিজিটাল রেভল্যুশন চলছে, যার দরুন আধুনিক মানুষ আর নাম নয় ধাম নয় স্রেফ সংখ্যামালায় বদলে যাচ্ছে, তার প্রতীক?

থার্ড বেল পড়তেই অদ্ভুত এক সুর ভেসে এল। বিজাতীয় এক সুর। একদল ছেলে ডাউনস্টেজের দখল নিল। তাদের আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা। শুধু একজন যে আর-পাঁচজনের ঘাড়ে উঠে ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া একটা পানামা হ্যাটে মাথা গলানোর জন্য জান কবুল করছে, তার পরনে কালো জামার ওপর স্যান্ডো গেঞ্জির মতো চাপানো। তার ঘাড়ের ওপর মাথা একটি আছে নিশ্চিত, তবে আলোছায়ার কারসাজিতে তা দেখার উপায় নেই। ছেলেটি কি এক কবন্ধ সংস্কৃতির প্রতীক? ওদিকে পশ্চিমি ছাঁদের বাজনা বাজছে। চনমনে ফুর্তি উথলে উঠছে কুশীলবদের দেহে-মনে। এরই মধ্যে কী যে হলো, সুতোর টানে ওপরে উঠতে থাকল ওই পানামা হ্যাট। উঠতে উঠতে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল। যেতে না-যেতেই বাংলায় রক মিউজিকের ঝংকার কানে এল। তাতে তাল মিলিয়ে শরীর দুলিয়ে নাচতে লাগল দশ-এগারোজন যুবক-যুবতী। ওই সংগীত ওই বিভঙ্গ ওই উত্তেজনা যে জীবনধারার ইশারা দিল, তা স্যাটেলাইট চ্যানেল আর মোবাইল টেকনোলজির দৌলতে আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। জোরালোভাবে বলা কয়েকটি কথা কানে এসে লাগল ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘থিয়েটার’, ‘জিন্দাবাদ’। আর তারপর অবাক হয়ে দেখলাম যে মিলিটারি বিউগলের তালে তাল ঠুকে একেকটি চাকা লাগানো কাঠের তক্তা আড়াআড়িভাবে উঠে এসেছে যুবকদের হাতে। মেশিনগান চালানোর ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে তারা। নেপথ্যে ভেসে আসছে অবিরাম গুলির আওয়াজ।

এই ধরতাইটুকু সেরে নিয়েই হাফ কার্টেন নামিয়ে দিয়ে আসল নাটকে আমাদের ঢুকিয়ে দিলেন নির্দেশক। কেতাদুরস্ত চারজন লোক অ্যাপ্রন পরে স্টেজে হাজির। ব্যাপারটা এ রকম যে উত্তর-ঔপনিবেশিক দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশে সদ্য এক সামরিক অভ্যুত্থান হয়ে গেছে। পগার পার হয়েছেন পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট। তার জায়গা নিয়েছেন সেনাবাহিনীর প্রধান। জরুরি বৈঠকে তাঁকে ঘিরে আছেন দেশের অর্থমন্ত্রী, নতুন আর্মি জেনারেল আর আগের জমানা ও এবারের জমানায় বহাল তবিয়তে বহাল থাকা সচিব। অভিনয় চড়া সুরে বাঁধা। তাতে প্রহসনের রং লেগেছে। কেষ্টুবিষ্টুদের মোসাহেবি দেখে চার্লি চ্যাপলিনের দ্য গ্রেট ডিকটেটর-এ অ্যাডলফ হিটলারের রকমারি মুদ্রাদোষ মনে পড়ে যাচ্ছে। কথাবার্তায় স্পষ্ট যে রিজার্ভ ব্যাংকের যা অবস্থা, তাতে জাহাজ বানানো তো দূরস্থান, একটি ঠেলাও বানানো যাবে না। তাতে কী! প্রেসিডেন্ট চাইছেন বাণিজ্য বিস্তার। তাঁর নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা নাগরিকদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে হরির লুট খেলতে বদ্ধপরিকর। তাঁর হাতে আছে অদ্ভুত ভোঁতা ছুরি, যা দিয়ে নাকি অঙ্গব্যবচ্ছেদ করা যায়, অথচ কারওর গায়ে আঁচড় কাটতেও ওই জং-ধরা ছুরি কাজে লাগে না। তবে উপায়? মুশকিল আসান করতে পুষ্পকরথে চড়ে গুচ্ছেক ধোঁয়া উড়িয়ে শূন্য থেকে নেমে এলেন এক বক্তিয়ার। সাদা কথায় ইন্টারন্যাশনাল নেগোশিয়েটর। নাম মিস্টার এক্স। আবহে ভেসে আসা জ্যাজ মিউজিক বুঝিয়ে দিল, ইনি জাতে মার্কিন। কী ভুলে কী চেনা যায়, দেশ বেচে কীভাবে রাজদণ্ড কেনা যায়, তা-ই বাতলাতে লাগলেন এই চালিয়াত। দেখতে দেখতে ক্যান্টনমেন্ট ব্যারাকের ঘেরাটোপে থাকা প্রেসিডেন্টের মন জুগিয়ে কলাটা আর মুলোটা বেচে সে দেশের প্রতিরক্ষা থেকে সামরিক বাহিনী—সবকিছু কবজা করে নিলেন মিস্টার এক্স। যাবার আগে গলা বাজিয়ে বলে গেলেন, ‘গণতন্ত্র আমার একমাত্র বিষ। মুনাফা আমার একমাত্র ঈশ্বর।’

দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল আবদুল্লাহ আল-মামুনকে। মনে পড়ছিল তাঁর ১৯৬৫ সালে লেখা নাটক শপথমর্ষকাম যেন শপথ-এর নান্দনিক উত্তরাধিকার। ঠান্ডা লড়াই চুকেবুকে গেছে। বিশ্বায়নকে ঢাল করে দুনিয়াজুড়ে একধরনের হাঁসজারু-মার্কা উদার অর্থনীতি চালু হয়েছে। এই নাটকের তিনটি পর্ব। কমবেশি আধঘণ্টা সময়সীমার। মোটের ওপর একই কথা তিন রকম প্রেক্ষাপটে কীভাবে খেটে যায় আমাদের মাথায়—গজাল মারার মতো করে তা ঢুকিয়ে দিতে চাইছে থিয়েটার আর্ট ইউনিট। দ্বিতীয় পর্বের সুতো ছড়াচ্ছে আফ্রিকার কোনো এক দেশে। তৃতীয় পর্ব মধ্যপ্রাচ্যে। পটভূমি পাল্টানোর সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে গান বাজনা নাচ এমনকি শরীর। ক্ষমতাসীনের বাচনভঙ্গি রয়ে যাচ্ছে এক রকমের। কার্যপ্রণালির ধরনটাও একই রকম। কুশীলবও তাই। একজন রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁকে ঘিরে থাকা জো হুজুর মার্কা সচিব, অর্থমন্ত্রী ও সেবাপ্রধান। আর তাদের মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢালার জন্য সেই মিস্টার এক্স। ‘এক্স’ শুনে ‘সেক্স’-এর দোহাই পাড়ছেন এক জো হুজুর। চকিতে মাথায় খেলে যাচ্ছে পশ্চিমি জীবনযাত্রায় অবাধ যৌনতার যে সচেতন নির্মাণ নানানভাবে আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে তার ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা পণ্যসভ্যতার কালসর্পের চেহারা। কীভাবে নব্য প্রসপেরোর দল তামাম দুনিয়াজুড়ে মৃগয়ায় নেমেছে, স্থলেজলেজঙ্গলে খুঁজে খুঁজে ফিরছে নয়া ক্যালিবানদের, তার হদিস দিচ্ছে। নাট্যকার স্পষ্ট করেই ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের খবরদারির কথা তুলছেন। মার্কেট ইকোনমির গরজে ফুলেফেঁপে ওঠা করপোরেট ক্যাপিট্যালের ক্ষুরে মাথা কামাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশ। বহুজাতিক পুঁজির ইশারায় নেচে কীভাবে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি চাইছে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থাকে বগলদাবা করতে, কোথায় রক্তকরবীর খনি মজুরের মতো আত্মপরিচয় খুইয়ে স্রেফ ইলেকট্রনিক ডিজিটে পর্যবসিত হচ্ছে যৌবন—এসবই উঠে এসেছে কথার পিঠে। কীভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের গাজর ঝুলিয়ে উন্নয়নশীল অর্থনীতির নয়া জমানার চালকদের তাঁবে আনার চেষ্টা চলে, কীভাবে দুনিয়াজুড়ে স্বৈরতন্ত্রী শাসকদের মৌরুসি-পাট্টা কায়েম হয়—এমন সব প্রসঙ্গ বাদ পড়েনি। কীভাবে মর্জিমাফিক যুদ্ধ বাধিয়ে গায়ের জোরে লক্ষ-কোটি মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া করার খেলা চলে, তা-ও ভোলেনি মর্ষকাম। আপনা-আপনি জুড়ে গেছে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের সঙ্গে। একটি তীব্র যুদ্ধবিরোধী স্বর মর্ষকাম-এর বুকে অন্তঃসলিলার মতো বয়ে চলেছে। এই স্বর আগাপাছতলা আন্তর্জাতিক। সত্যি বলতে কি, এমন গভীর বিশ্ববীক্ষণ তরুণ নাট্যকার আনিকা মাহিন একার কবজির জোরের দিকে বারেবারে আমাদের নজর ফিরিয়েছেন। তাঁকে বাহবা দিতে মন চেয়েছে। নির্দেশক অনেকখানি করে জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন সহযোগীদের। গান বাজনা নাচের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, যাঁরা মঞ্চ সাজিয়েছেন আলো ফেলেছেন তাঁদের সবাইকে একসঙ্গে জুটিয়ে স্রোতের উজানে বেয়ে এ ধরনের নাট্যনির্মাণে অনেক প্রায়োগিক অসুবিধা থাকে। এক স্তরের পেশাদারি মনোভাব না থাকলে এ ধরনের নির্মাণকে বহন করা দায় হয়। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ নভেম্বর ঢাকায় প্রথম মঞ্চস্থ হবার পর পনেরো মাসের মধ্যে মর্ষকাম-এর পনেরোটি শো হলো। এ বড় কম কথা নয়।

নাটক শেষ হবার পর ‘মর্ষকাম’-এর একটি অর্থ বেবাক সাফ হয়ে গেল। এই মর্ষের আদিতে আছে নাশন। এই মর্ষকাম হলো যেনতেনপ্রকারেণ তামাম দুনিয়াকে পায়ের তলায় পিষে মারার তাল।