কাজ তো কেবল শুরু হলো
অবশেষে চলে এল সেই মাহেন্দ্র দিবস। ১৩ এপ্রিল, চৈত্রের শেষ দিন। ২০১৮-তে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় সম্পূর্ণ করল তার প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী এবং সাড়ে চার দশক ধরে দর্শনীর বিনিময়ে তাৎপর্যপূর্ণ নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন। ১৩ এপ্রিল নির্ধারিত হয়েছিল এই দুই স্মরণীয় অর্জনের উদ্যাপন। ওই দিনই শেষ নয়, নাগরিকের নাট্যজনেরা তিন দিনব্যাপী উত্সবের আয়োজন করেছিল ১৩-১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। নাগরিকের সঙ্গে আমি আছি ১৯৭২ সাল থেকে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সেই তারুণ্য থেকে আজ এই প্রবীণ বয়সে এসে পৌঁছেছি। কত যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা তা লিখতে গেলে একটি গ্রন্থ রচনাই হয়ে যাবে হয়তো। আমি যখন থেকে নাগরিকে, ঠিক তখন থেকে ঘটনাচক্রে নাগরিক মঞ্চে সচল। ৪৫ বছর ধরে মাঝেমধ্যে অল্প সময়ের জন্য যতি দিয়ে মঞ্চে একাদিক্রমে ৪৫ বছর ধরে নাটক করে যাওয়া বোধ হয় বেশ কঠিন, বিশেষ করে এর পেছনের কারণ যদি একটিই হয়, কেবল নাটকের প্রতি ভালোবাসা। মঞ্চে নাটক করে এ দেশে অর্থায়ন এখনো অসম্ভব। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি যে বিশ্বের নাট্যকেন্দ্রসমূহে, যেমন নিউইয়র্ক কিংবা লন্ডনে, ভালো নাটক করে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব হতো না, যদি না ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো অথবা সরকার ভর্তুকি না দিত। বাংলাদেশে একটা সময় ছিল যখন সরকার কিংবা ব্যবসায়ী কারোরই সচ্ছলতা এমন ছিল না যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে সহায়তা প্রদান করে। এখনো অন্যান্য সর্বব্যাপী এবং সর্বগ্রাসী মৌলিক প্রয়োজন উপেক্ষা করে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে নিয়মিত অর্থায়ন করা আমাদের সরকারের পক্ষে সম্ভব বলে আমি মনে করি না। কিন্তু ৪৭ বছরের ইতিহাসে ইতিমধ্যে আমাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো পত্র-পুষ্পে পল্লবিত হয়ে উঠেছে। তারা চাইলেই অনায়াসে একটা বার্ষিক বরাদ্দ রাখতে পারে নিয়মিত সংস্কৃতিচর্চার জন্য। এটি ব্যবসায়ীর সামাজিক দায়িত্ব অথবা করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটির আওতাভুক্ত হতে পারে সহজেই। এই সহায়তা আমাদের শুদ্ধ নাট্যচর্চাকে আরও এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
আমার প্রথম যুক্তরাজ্য সফরে (১৯৭৪) শেক্সপিয়ারের মিড সামার নাইটস ড্রিম নাটকের একটি মঞ্চায়ন দেখেছিলাম স্ট্র্যাটফোর্ড আপন এভন শহরের শেক্সপিয়ার থিয়েটারে। দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। নানা বয়সের এত অভিনেতার সমাহার, হলের মঞ্চ থেকে আরম্ভ করে বাইরে সর্বত্র নাটকের উপযোগী করে বিশদ দৃশ্য সজ্জার আয়োজন। এর পেছনে বিশদ অর্থায়নের প্রয়োজন। এই যে কর্মযজ্ঞ এর পেছনে ছিল রয়েল শেক্সপিয়ার কোম্পানি। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে এই নাট্যদলের সব কর্মকাণ্ড এমনকি অভিনেতা-অভিনেত্রীর বেতন পর্যন্ত প্রদান করা হয় ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা আর্টস কাউন্সিলরের মাধ্যমে। এই আপাত নীরস বিষয়ে এতগুলো কথা বললাম এই কারণে যে, এখন যা করছি তার তুলনায় আরও বড় এবং বিশদ আকারে নাটক করে যেতে চাই যত দিন দেহে আছে প্রাণ এবং সেই সময়ের মধ্যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এমন একটি ক্ষেত্র আমরা তৈরি করে দিয়ে যেতে চাই, যেখানে সত্যিকারের নাট্যপ্রেমিকের জন্য নাট্যকর্ম সহজতর হবে। অতএব এর অর্থকরি বিষয়েও চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন রয়েছে বৈকি এবং তা করতে হবে আমাদেরই, যারা এই কর্মকাণ্ডের সূচনা থেকে আছি এর সঙ্গে।
আজ নাট্যকলায় গুরুত্বপূর্ণ এক অর্জনের পর এ কথা স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসতে পারে যে নাটক কেন করি। এর নানা রকম উত্তর হতে পারে। আমার এক চটুল বন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার ইচ্ছে আমি নাটক করি। তোর কী?’ একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাব যে চিন্তাশীল মানুষমাত্রই একটি স্বতন্ত্র অভিব্যক্তি খুঁজে ফেরেন। এ এক স্বতন্ত্র ভাষাও বটে। যে ভাষাটি চিন্তাশীল মানুষের নিজস্ব দর্শনসঞ্জাত। কেউ কবিতা লিখে নিজেকে মুক্ত করেন, কেউ ছবি এঁকে নিজেকে ব্যক্ত করেন। আমি নাটক করে নিজেকে উন্মোচিত করি। এ যেমন এক অপার আনন্দের ব্যাপার, তেমনি এক স্বর্গীয় পরিপূর্ণতা এনে দেয় আমাকে।
২০১৮-এর এপ্রিলে সংঘটিত নাটকের উত্সব আমাকে এক অশেষ পরিপূর্ণতায় ভরে দিয়ে গেছে। আমি সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছি আবার। এই বয়সে এসেও মনে হয়েছে কাজ তো কেবল শুরু করলাম!