স্মৃতিতে লাকী আখান্দ্

লাকী আখান্দ্
লাকী আখান্দ্

২১ এপ্রিল সংগীতজ্ঞ লাকী আখান্দের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে স্মরণ করেছেন গীতিকবি কবির বকুল

সংগীত যদি হয় একটা উর্বর জমিন, তবে সেই জমিনের সুমিস্ট ফলবান বৃক্ষ লাকী আখান্দ্‌। একটি বছর হতে চলল, তিনি আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। মৃত্যু অবধারিত। তার কাছে যেতেই হবে। তবে সেই মৃত্যুর মিছিলে যাওয়া মানুষদলের কেউ কেউ রেখে যান তাঁর কর্মছায়া। আর সেই ছায়ায় সুশীতল হই আমরা প্রতিদিন। লাকী আখান্দ্‌ তেমনই একজন। তাঁকে নিয়ে লিখতে হবে ভাবিনি। সেই যোগ্য আমি হয়েও উঠিনি। তবু কখনো কখনো পরিস্থিতি সে রকম সুযোগ এনে দেয়।
আমি সংগীতাঙ্গনের একজন সৌভাগ্যবান মানুষ। গত ৩১ বছর এই অঙ্গন থেকে না চাইতেই অনেক কিছুই পেয়েছি। তার একটি—লাকী আখন্দের সান্নিধ্যে আসা। তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়া। সেই কাজ করার সময়টুকু নিয়েই আমার স্মৃতিচারণা।
সম্ভবত ২০০৮ সালের কথা। মিলিয়া ইসলাম নামের একজন সংগীতশিল্পী আছেন। বৈবাহিক কারণে তিনি এখন প্রবাসী। ওই সময় তিনি দেশে এসেছেন একটা গানের অ্যালবাম করবেন বলে। ফোনে যোগাযোগ করে বললেন, আমার লেখা গান গাইতে চান। কয়েকটা গান লিখে দিতে। জানতে চাইলাম, সুর করবেন কে? তিনি বললেন, লাকী আখান্দ্‌। আমি শুনে অবাক। বললাম, তিনি কি জানেন, কে গান লিখছেন? মিলিয়া ইসলাম বললেন, লাকী ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করেই আপনাকে ফোন করেছি। তিনিই বলেছেন, কবিরের লেখা গান করা হয়নি। ওর কাছ থেকে গান নেন। মিলিয়া ইসলামের কথা শুনে আমি অবাক। কারণ লাকী ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়টা বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে। এরপর থেকে যখন যেখানেই দেখা হতো, সেখানেই তাঁর স্নেহের পুরোটা ঢেলে দিতেন আমার ওপর। কিন্তু কাজ করার সৌভাগ্য কখনো হয়ে ওঠেনি।
বিটিভিতে আমি নিয়মিত একটি অনুষ্ঠান করতাম ‘সুর সম্ভার’। সেই অনুষ্ঠানে তিনি ও কাউসার আহমেদ চৌধুরী এসেছিলেন। কাউসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা গান গেয়েছেন। গানের পেছনের গল্পগুলো দুজন মিলে বলেছেন।
এবার যখন মিলিয়া ইসলামের কাছে শুনলাম, তিনি আমার গানে সুর দেবেন, তখন বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে লাকী আখান্দ্‌ আমার গান করবেন। তবে সবচাইতে অবাক করা বিষয়টি হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছিল এরপর। আমি গান তৈরি করে মিলিয়া আপাকে জানালাম। তিনি বললেন, লাকী ভাই গান নিয়ে বসতে চান। বললাম, কোনো অসুবিধা নেই। আমাকেই ফোন করে সময় ঠিক করে নিতে বললেন। লাকী ভাইকে ফোন করার পর তিনি যা বললেন, তাতে আমি বিস্মিত। বললেন, ‘আমার বাসা তো আরমানীটোলা। তোমার বাড়ি থেকে বেশ দূরে। অসুবিধা না থাকলে আমি তোমার বাড়িতেই বসতে পারি।’ শুনে আমি তো অবাক।
এরপর নির্দিষ্ট দিনে সন্ধ্যায় তিনি এসে হাজির। মিলিয়া ইসলামও এলেন। লাকী আখান্দ গিটার নয়, হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়লেন। মিলিয়া ইসলামের জন্য লেখা প্রথম গান হারমোনিয়ামের সামনে মেলে দিলাম-‘তোমার আমার সম্পর্কটা যেন দুটি চোখের মতো, দেখা হয় না, কথা হয় না, কত যুগ হয়ে গেছে গত’। গানটি বেশ কয়েকবার পড়লেন, তারপর সুরও করে ফেললেন। আমরা মুগ্ধ শ্রোতা। এরপর দ্বিতীয় গান ‘উনিশের গল্প তিরিশে এসে আজো স্বপ্নের মতো মনে হয়, প্রথম ভালোবাসা প্রথম স্বপ্নে ভাসা সেই দিনগুলো যেন ভুলবার নয়’। এভাবেই চলল ঘণ্টা তিনেক। রাত ১০টায় মুন্নী (আমার স্ত্রী) সবাইকে ডাকল রাতের খাবার খেতে। লাকী ভাই খেতে খেতে বললেন, ‘মুন্নী, তুমি তো দারুণ রান্না করো। কিন্তু আমি বাংলা খাবারের চেয়ে কন্টিনেন্টাল ফুড বেশি পছন্দ করি। পরে যেদিন আসব, সেদিন তুমি আমাকে কন্টিনেন্টাল ফুড খাওয়াবে।’
লাকী আখান্দ্‌ শিল্পী মিলিয়া ইসলামের জন্য আমার লেখা চারটি গান সুর করেছিলেন। তাঁর অ্যালবামের শিরোনামও হয়েছিল ‘উনিশের গল্প’। সময় চলে গেছে। তবে আমাদের বাড়িতে কন্টিনেন্টাল ফুড খেতে আসার সুযোগ আর পাননি। তাঁর অসুস্থতা। তারপর ওপারে চলে যাওয়া-এ সবই এখন সত্য। এক বছরও চলে গেল। স্মৃতিচারণা আর তাঁর অনন্য সৃষ্টির মাঝেই আমরা তাঁকে খুঁজে বেড়াব।