৩৫ বছর পর নতুন গান নিয়ে অ্যাবা

অ্যাবা। ছবি: এএফপি
অ্যাবা। ছবি: এএফপি

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সুইডিশ ভাষাভাষী ইংরেজি গানের দল অ্যাবার নতুন কোনো গান তৈরি হয়নি। খুশির খবর হলো, ৩৫ বছর পর ব্যান্ড সংগীতপ্রেমীদের তৃষ্ণা মেটাতে একসঙ্গে হাজির হচ্ছেন অ্যাবার চার সদস্য অ্যাগনেথা ফ্যালস্কু, বিয়র্ন ক্রিস্তিয়ান, বেনি অ্যান্ডারসন ও অ্যানি-ফ্রিদ লিংস্তদ। নতুন গানের ঘোষণা তাঁদের কাছ থেকেই এসেছে।

ইনস্টাগ্রামে অ্যাবার অফিশিয়াল পেজে গতকাল শুক্রবার দলের সদস্যরা এক বিবৃতিতে বলেন, তাঁরা শ্রোতাদের সামনে নতুন গান নিয়ে হাজির হচ্ছেন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আমরা চারজন ভাবলাম প্রায় ৩৫ বছর পর আবার একসঙ্গে রেকর্ডিং স্টুডিওতে ঝাঁপিয়ে পড়লে বেশ মজা হবে। আমরা তেমনটাই করেছি। মনে হলো সবকিছু সেই আগের মতোই আছে, আমরা কয়েক দিনের ছুটিতে গিয়েছিলাম মাত্র। নতুন গান রেকর্ড করতে গিয়ে ভীষণ আনন্দের অভিজ্ঞতা হয়েছে।’

অফিশিয়াল ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে এই যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে অ্যাবা
অফিশিয়াল ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে এই যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে অ্যাবা

সেই বিবৃতি থেকে আরও জানা যায়, এবার অ্যাবা নতুন দুটি গান তৈরি করেছে। নতুন গান দুটি কবে মুক্তি পাবে, তা অবশ্য এখনো ঠিক হয়নি। এর মধ্যে একটি গানের শিরোনাম ‘আই স্টিল হ্যাভ ফেইথ ইন ইউ’। গানটি ডিসেম্বর মাসে এনবিসি ও বিবিসি চ্যানেলের বিশেষ আয়োজনে বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্য পরিবেশন করবে অ্যাবা। অন্য গানের বিষয়ে এখনো এই শিল্পী চতুষ্টয় কিছু জানাননি। অ্যাগনেথা, বিয়র্ন, বেনি ও অ্যানি-ফ্রিদ সম্মিলিত এই পোস্টে বলেন, ‘আমরা বুড়ো হতে পারি, তবে আমাদের গানটি কিন্তু একেবারে নতুন। এটি ভাবতেই খুব ভালো লাগছে।’

এত বছর পর স্টুডিওতে পুরোনো চার বন্ধুর মিলন মেলা কেমন ছিল? অ্যাবার মুখপাত্র জোরেল হ্যানসারের মতে, ‘স্টুডিওর পরিবেশ তখন জাদুময় হয়ে উঠেছিল।’ কোন ফাঁক দিয়ে যে সময় চলে গেছে, টেরই পায়নি কেউ। অ্যাবার প্রতিটি সদস্য সেদিন ভীষণ উচ্ছ্বসিত ছিলেন। মাঝে সম্পর্কে যেই ছেদ পড়েছিল, তার কোনো ছাপই ছিল না তাঁদের সাবলীল ব্যবহারে। পুরোনো দিনের মতোই হাসি, আনন্দ আর গল্পে গল্পে দুটি গান রেকর্ড করেন তাঁরা। গত শতকের সত্তর দশকের শ্রোতাদের পাগল করা ব্যান্ড অ্যাবার এমন মিলন মেলা সেদিন জোরেলের মতো স্টুডিওতে উপস্থিত অনেকের চোখেই জল এনে দেয়। তবে এই অশ্রু আনন্দের আর তৃপ্তির। অনেক বছর ধরে কাঙ্ক্ষিত কোনো বস্তুর প্রাপ্তিতেই চোখে এই তৃপ্তির অশ্রু আসে।

অ্যাবা ব্যান্ডের চার সদস্য এখন দেখতে যেমন। ছবি: এএফপি
অ্যাবা ব্যান্ডের চার সদস্য এখন দেখতে যেমন। ছবি: এএফপি

কিন্তু অ্যাবা-ভক্তদের কিছুটা অতৃপ্তি থেকেই যাবে। কারণ নতুন করে গান গাইলেও লাইভ পারফরম্যান্স করবেন না অ্যাবা ব্যান্ডের চার সদস্য। তাঁদের আসন্ন ‘অ্যাবা অ্যাভাটার ট্যুর’-এ হলোগ্রাম প্রযুক্তির ব্যবহার করা হবে। জোরেলের মতে, এত বছর পর তাঁরা একসঙ্গে নতুন গান রেকর্ড করেছেন, এ-ই ঢের। এখনই ‘এত বেশি’ প্রত্যাশা না করার পরামর্শ দেন সত্তরের দশকে গঠিত এই ব্যান্ডের মুখপাত্র।

একসঙ্গে গান রেকর্ড ও পরিবেশন তাঁরা বন্ধ করে দেন ১৯৮২ সালে। এরপর বহুবার তাঁদের একসঙ্গে গাইতে অনুরোধ করা হয়েছে। অ্যাবা পুনর্গঠনের জন্য নানা মহল থেকে চাপ পর্যন্ত দেওয়া হয় তাঁদের। ২০০০ সালে একটি ট্যুরের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ প্রস্তাব করলে সেটিও ফিরিয়ে দেয় অ্যাবা। কিন্তু কেন? পাঁচ বছর আগে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য অ্যাগনেথা বলেন, ‘অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। আমাদেরও বয়স হয়ে গেছে। তা ছাড়া আমাদের প্রত্যেকের এখন আলাদা জীবন আছে। আমরা যে যে যার যার মতো ব্যস্ত।’

অ্যাবার এই নতুন সূচনায় সবচেয়ে বেশি আনন্দিত তাদের ভক্তরা। তাদের নতুন গান দুটি কেমন শোনাবে? সেখানে কি খুঁজে পাওয়া যাবে সত্তরের আমেজ নাকি চির তরুণ ব্যান্ড অ্যাবা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি করেছে তাদের নতুন ট্র্যাক? এমন শত প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে অ্যাবা-প্রেমীদের।

অবশ্য ‘ওয়াটার লু’, ‘চিকিচিটা’, ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’, ‘টেক ইট ইজি’, ‘ড্যান্সিং কুইন, ও ‘মামা মিয়া’র স্রষ্টাদের প্রতি ভরসা আছে ভক্তদের। অ্যাবার নতুন গানের শিরোনামের মতোই এখনো তাঁদের ওপর বিশ্বাস আছে শ্রোতাদের। তাঁরা ঠিক জানেন, বেনি আর বিয়র্নের কাছে ভালো না লাগলে তাঁরা নতুন কোনো গান প্রকাশ করবেন না।

‘আমেরিকান আইডল’ অনুষ্ঠানের ভাবনা যার, তিনিই অ্যাবার সদস্যদের মঞ্চে হাজির করার কথা ভেবেছেন। নাম তাঁর সাইমন ফুলার। বিনোদন উদ্যোক্তা হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। নব্বই দশকের জনপ্রিয় ব্রিটিশ ব্যান্ড স্পাইস গার্লসের ব্যবস্থাপক হিসেবেও আছেন সাইমন। তিনি একবার সুইডেনে গিয়ে অ্যাবার সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের বোঝান, বাস্তবে মঞ্চে হাজির না হয়েও একসঙ্গে পরিবেশন করার উপায় আছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে অ্যাগনেথা, বিয়র্ন, বেনি ও অ্যানি-ফ্রিদের মতোই দেখতে হুবহু চারজনের অবয়ব তৈরি করা হবে। ছবি, ভিডিও ও আলোক প্রক্ষেপণের মাধ্যমে তৈরি এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় হলোগ্রাফি। আর এই পদ্ধতিতেই সংগীত ভ্রমণে অংশ নেবে অ্যাবা! অ্যাবা অ্যাভাটার ট্যুর নামের এই ভ্রমণ হতে যাচ্ছে অ্যাবার জন্য এক ট্রিবিউট ট্যুর।

বিয়র্ন বিবিসির সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়ে বরাবরই কৌতুহলী। তাই নতুন এই পদ্ধতি তাঁর খুব মনে ধরেছে। সত্যিকারের মানুষ নয়, তবে মঞ্চে তাঁদের দেখতে রক্ত-মাংসের মানুষের মতোই দেখাবে। বিষয়টি চমকজাগানিয়া বটে। এটি ভাবতেই তাই বিয়র্ন রোমাঞ্চিত বোধ করেন। তিনি আরও বলেন, ‘এটি একটি নতুন প্রযুক্তি আর এভাবে মঞ্চ পরিবেশনার ক্ষেত্রে আমরাই অগ্রগামী হতে যাচ্ছি। ব্যান্ডের অন্য তিন সদস্যও এতে অনেক খুশি।’

কিন্তু এক হওয়ার জন্য প্রযুক্তিতেই কেন ভর করতে হলো অ্যাবার? সত্যি সত্যি তাঁরা মিলিত হলেন না কেন? এমন প্রশ্নেরও সম্মুখীন হতে হয় বিয়র্নকে। শিল্পীর সরল উত্তর, ‘সত্তরের দশকে মানুষ আমাদের যেভাবে দেখেছেন, এখনো ঠিক সেভাবেই কল্পনা করেন। তখন আমরা ছিলাম তরুণ ও প্রানোচ্ছল একটি ব্যান্ড। আমরা যে এত বছর ধরে পুনর্মিলনের প্রস্তাব পাইনি, তা কিন্তু নয়। তবে আমরা গান নিয়ে ভ্রমণ করার আগ্রহই পাইনি আর।’

পাঠক জেনে রাখুন, তুমুল জনপ্রিয় আর চাহিদার তুঙ্গে থাকা এই সুইডেনভিত্তিক ইংরেজি গানের দলটি টানা ১০ বছর শ্রোতাদের নতুন গান উপহার দিয়েছেন। কিন্তু ট্যুর করেছেন সব মিলিয়ে মাত্র সাত মাসের মতো।

সত্তর দশকের এই ব্যান্ডের বড় বৈশিষ্ট্য ছিল আধুনিকতা ও স্বাতন্ত্র্য। ছবি: এএফপি
সত্তর দশকের এই ব্যান্ডের বড় বৈশিষ্ট্য ছিল আধুনিকতা ও স্বাতন্ত্র্য। ছবি: এএফপি

১৯৭২ সালে গঠিত এই ব্যান্ডে বিয়র্ন আর বেন গীতিকার। অ্যাগনেথা ও অ্যানি-ফ্রিদ কণ্ঠশিল্পী। একক শিল্পী হিসেবেও তাঁরা সফলতার স্বাদ পেয়েছিলেন। কিন্তু এই চার রত্ন এক হওয়ার পর যেই সাফল্য তাঁদের ছুঁয়েছে, তা অতীতের সব সাফল্যকে পিছে ফেলে দেয়। গান গেয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আয় করেছে অ্যাবা। লাগাতার হিট অ্যালবাম উপহার দিয়ে গেছেন শ্রোতাদের। বিশ্বব্যাপী অ্যাবা ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশ্চুম্বী। একটা সময় ছিল যখন অ্যাবার নতুন কোনো গান প্রকাশ পাওয়া মানেই নিশ্চিত হিট। টপচার্চের শীর্ষে উঠে আসত সেসব গান। অ্যাবার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁদের স্বাতন্ত্র্য। প্রতিটি গানে তাঁরা নিজেদের নতুনভাবে উপস্থাপন করতেন। অন্যদের নয় বরং নিজেদের জনপ্রিয়তাকেই অ্যাবা ছাড়িয়ে গেছে বারবার। ভালোবেসে বিয়র্ন বিয়ে করেছিলেন অ্যাগনেথকে, আর বেনি করেছিলেন ফ্রিদাকে। কিন্তু আশির দশকে এসে তাঁদের সম্পর্কে ছেদ ঘটে। বিশ্ব মাতাল করা এই ব্যান্ড সদস্যদের বৈবাহিক সম্পর্কের ভাঙন প্রভাব ফেলে ব্যান্ডের ওপরও। ১৯৮২ সালের পর অ্যাবার আর কোনো নতুন গান আসেনি। একসঙ্গে তাঁদের শেষ পরিবেশনা ছিল এর তিন বছর পর। সেটি অ্যাবার শেষ পাবলিক পারফরম্যান্স।

অ্যাবার নতুন গান প্রকাশ পাওয়ার খবরে আশায় বুক বেঁধেছেন অনেকে। এই দুটি কি শেষ, নাকি এরপর আরও গান নিয়ে হাজির হবে অ্যাবা? না, অ্যাবার মুখপাত্র জোরেলের কথাতেই আবার ফিরে যেতে হয়, এখনই এত বেশি প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না।