২০ হাজার বর্গফুটের পুরোটা জুড়ে নাটক

মহাস্থান নাটকের কারিগরি মঞ্চায়নের একটি দৃশ্য। ছবি: হাসান রাজা
মহাস্থান নাটকের কারিগরি মঞ্চায়নের একটি দৃশ্য। ছবি: হাসান রাজা


এ যেন নাটক নয়, মহানাটক! দুই ঘণ্টায় আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস। কখনো কথায়, কখনো গানে বা নৃত্যে। ২০ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে আলো-ছায়ার খেলায় তাক লাগানো পুরো দুই ঘণ্টা। এই দুই ঘণ্টা জাতীয় চিত্রশালার প্লাজায় দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন নতুন নাটক ‘মহাস্থান’।

নাটকটি ইতিহাসনির্ভর। ইতিহাস বলছে, বাংলায় হাজার বছরের ঐতিহ্যের যে প্রাচুর্যময় সম্ভার রয়েছে, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো তার মধ্যে অন্যতম। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে এই নিদর্শনগুলোর মধ্যে বগুড়ার মহাস্থানগড় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। একসময় বাংলার রাজধানী ছিল, আড়াই হাজার বছর আগে এখানে জনপদ গড়ে উঠেছিল। এসব ইতিহাস নানাজনে পঠিত। বহুকাল ধরে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে। মহাস্থানগড়কে সার্ক কালচারাল সেন্টার ২০১৬ সালে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ফেলে আসা বাংলার আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে মহাস্থান নাটকটি লিখেছেন সেলিম মোজাহার। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর নির্দেশনায় কারিগরি মঞ্চায়ন হয়ে গেল শনিবার।

শিল্পকলা একাডেমিতে এত বড় পরিসর নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ হতে আগে দেখা যায়নি। জাতীয় চিত্রশালা প্লাজার ২০ হাজার বর্গফুটের পুরোটা জুড়ে ছিল শিল্পীদের পদচারণ। নেপথ্য থেকে আসা গান এবং কথকের বর্ণনার ফাঁকে মঞ্চে শিল্পীদের সংলাপ, নৃত্য এবং নানা কর্মকাণ্ডে ফুটে ওঠে বাংলার ইতিহাস।

কত কিছু দেখা গেল এক নাটকে! প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে সময়ের পরম্পরায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পর্যন্ত সময়কাল; শিকার যুগ থেকে শুরু করে বৈদিক যুগ, আদিবাসী পর্ব, রামায়ণের গীত, কালিদাসের কাব্য, চর্যাপদ, সফিনামা, বৈষ্ণব পদাবলি, ব্রাহ্মসংগীত, লোকগান, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ব্রতচারীদের গান, পঞ্চকবির গান, ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাস। এসব কীর্তি, কৃষ্টি ও সভ্যতার ইতিহাস তুলে ধরলেন ১২৫ জন শিল্পী।

নাটকের শেষ ৫ মিনিট বেশি মনে ধরেছে। নাটকের সারকথা দেখা গেল এ সময়টাতে। মঞ্চের এক-একটা অংশে আলো জ্বলে আর দেখা যায় নানা সময়ের চিত্র। ঠিক মাঝখানে একজনের প্রতীকী পদচারণ (মাইম)। যেন তিনিই আড়াই হাজার বছরের পান্থজন। নেপথ্যে ভেসে আসে সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ কবিতাপাঠ। ভরাট কণ্ঠে একজন পাঠ করেন, ‘...এই ইতিহাস ভুলে যাব আজ আমি কি তেমন সন্তান/যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান; তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি/চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।’ কবিতার পাশাপাশি পুরো নাটক তথা আড়াই হাজার বছরের গল্পটা আরেকবার দেখলেন দর্শক। শেষে সব শিল্পী এবং দর্শক মিলে জাতীয় সংগীত গেয়ে ওঠেন। সে সময় অনেক শিল্পীর চোখে ছিল ভেজা।

নাটক শেষে কথা হলো নির্দেশক লিয়াকত আলী লাকীর সঙ্গে। ছয় মাসের নিয়মিত মহড়ার পর সফল মঞ্চায়ন শেষে আপ্লুত তিনিও। ভেজা চোখে জানালেন, তিনি এ যাবৎ ৮২টি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে মহাস্থান নাটকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এত বড় এবং এমন বিচিত্র প্রযোজনার অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। তিনি বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের সামনে ইতিহাস-ঐতিহ্য উপস্থাপনের পাশাপাশি আমাদের যে সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের আলোকিত অধ্যায় রয়েছে, সেটাই মহাস্থান নাটকের মধ্য দিয়ে প্রকাশের চেষ্টা করা হয়েছে। নাটক শেষে দর্শকের মনে হবে, আমরা গর্বিত জাতি।’

বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রত্ননাটক করছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। নিয়মিতভাবে প্রত্ননাটকের প্রচলন করেছেন লিয়াকত আলী লাকী। এর আগে নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার এবং নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর স্থাপনা নিয়ে দুটি প্রত্ননাটক বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি মঞ্চস্থ করেছে।