স্কলাসটিকার 'অচলায়তন'

অচলায়তন নাটকের দৃশ্য
অচলায়তন নাটকের দৃশ্য

স্থবির এক রাজ্যপাটে হঠাৎ সব এলোমেলো হয়ে গেল! নিয়মকানুনের বাইরে গিয়ে পৃথিবী দেখার সাধ হলো কারও কারও এবং যাঁর কাছ থেকে বাধা পাওয়ার কথা সবচেয়ে বেশি, তিনিই দেখালেন মুক্তির পথ। এই তো অচলায়তন নাটকের মূল ভাবনা।

যদি বড়দের কোনো দল নাটকটি করত, তাহলে এক কথা। এই নাটকটি করেওছে অনেক দল। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের বেশ জনপ্রিয় নাটক ছিল এটি। মনে পড়ে, খালেদ খানের মঞ্চমাতানো পারফরম্যান্সের কথা? সে ঘটনা অনেক দিন আগের। আমরা যে অচলায়তন-এর কথা বলছি, সেটি করেছে খুদে শিশুরা। স্কলাসটিকা স্কুলের একেবারে শিশু বিভাগকে দিয়ে করানো হয়েছে নাটকটি। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, স্কলাসটিকা জুনিয়র উত্তরা ড্রামা, মিউজিক ও ডান্স ক্লাবের আয়োজন ছিল এটি।

মজার ব্যাপার হলো, এই নাটকের প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনি নাটকটি দেখে বললেন, একসময় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নাটকটিতে তিনিও মাঝে মাঝে দাদা ঠাকুরের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। অভিনেতা আবুল হায়াত কোনো কারণে বিশ্রামে গেলে আসাদুজ্জামান নূরকে করতে হতো দাদা ঠাকুরের ভূমিকায় অভিনয়।

কেমন করল এই শিশুরা? এ কথা তো বলাই যায়, মহা উৎসাহের সঙ্গে সংলাপ আউড়েছে এরা, কণ্ঠ মিলিয়েছে গানে, নেচেছে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে। ফলে মঞ্চটাকে শূন্য বলে মনে হয়নি কখনো। এমনকি নাচতে নাচতে অন্য কাউকে কিছু মনে করিয়ে দেওয়া, সংলাপ ভুলে গিয়ে পাগলের মতো সংলাপের শেষ লাইনে এসে পৌঁছাত—এ রকম কিছু ঘটনা যখন বয়সী চোখের সামনে দিয়ে গেছে, তখনো নাটকের মূল রস থেকে সরে যাওয়া যায়নি একটুও। কারণ, ওদের বয়স মনে রাখলে এগুলো যে নাটকের নান্দনিক আবেদন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, সে কথা বললে অত্যুক্তি হয় না।

অচলায়তন যারা পড়েছে, তাদের মনে পড়বে, পঞ্চক নামের ছেলেটির কথা। ‘ওমঃ তট তট তোতয় তোতয়’ মন্ত্রে যার মন নেই। সবাই সবকিছু শিখে ফেলে, না, বুঝে মুখস্থ করে ফেলে, কিন্তু পঞ্চকের তা ভালো লাগে না। শোণপাংশুদের সঙ্গেই ওর সখ্য। তাবড় তাবড় বিজ্ঞ মানুষেরা ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। সংস্কারে বাঁধা ওই অচলায়তনে যখন আলোর দিশা পাওয়া যায়, তখনই জীবনের আসল লক্ষ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। স্কলাসটিকার খুদে শিক্ষার্থীরা নাটকের এ জায়গাটিও ফুটিয়ে তুলেছে সুন্দরভাবে।

নাটক শেষে সংস্কৃতিমন্ত্রী সহজে ছাড়া পেলেন না। নাটকের কুশীলব আর অতিথিদের নিয়ে মঞ্চে ওঠার পর তাঁর কাছে আবৃত্তি করার জন্য অনুরোধ এল। তিনি তখন পাঠ করলেন নূরলদীনের সারা জীবন থেকে সেই অংশটুকু, যা এখনো রোমাঞ্চিত করে হৃদয়, যে সংলাপের শেষ পর্যায়ে আছে সেই অসাধারণ বাক্যটি ‘জাগো বাহে, কুন্ঠে সবায়’।

নাটকটি পরিচালনা করেছেন শারমিন আক্তার রূপা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সায়মা কানিজ আর তমালিকা পাল। এই তমালিকা পালই আবার নাচের যোগ্য করে তুলেছেন শিশুদের। নাটকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন সৈয়দা লুৎফুন্নেসা শাওন।

যে শিশুরা অভিনয় করেছে, আলাদা করে তাদের কারও নাম লিখলাম না স্রেফ এই কারণে যে, কারও নামে আলাদাভাবে বাহবা দিলে অন্যরা মন খারাপ করবে। সবাই ভালো করেছে, তাই সবাইকে অভিনন্দন।
তারপরও একটু বলি, গানের তালে তালে নাচের সময় দুটি শিশুর দিকে আটকে গিয়েছিল চোখ, মঞ্চ থেকে নেমে শোণপাংশুদের নাচ দেখে চমকে গেছি, আর নাটকের সংলাপে অতিথিদের বরণ করে নেওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতেই হঠাৎ যখন নাটকের অতিথিদেরও বরণ করে নেওয়া হলো, তখন বোঝা গেল এ নাটকটি তৈরি করতে শুধু শারীরিক পরিশ্রমই করা হয়নি, মাথাও খাঁটাতে হয়েছে।
স্কলাসটিকা স্কুলের শিশুরা বাংলা নাটকটির সংলাপ বলার সময় বাংলা উচ্চারণের প্রতি বিশ্বস্ত ছিল দেখে মন ভরে গেছে। ওদের আরও আরও সাফল্য কামনা করি।
স্কলাসটিকা স্কুলের উত্তরা শাখার মিলনায়তনে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল ২৮ এপ্রিল, শনিবার সন্ধ্যায়।