তবুও আমার কুঠরি ভীষণ অন্ধকার...

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডলে দ্য লোয়ার ডেপথস নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: হাসান রাজা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডলে দ্য লোয়ার ডেপথস নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: হাসান রাজা

‘প্রতি ভোরে আমার জানালায় ঠিকই সূর্য ওঠে, তবুও আমার কুঠরি ভীষণ অন্ধকার...’—নাটমণ্ডল থেকে বের হয়ে কয়েকজন তরুণ গানটা গাইছিলেন জোরে জোরে। একটু আগে শেষ হয়েছে দ্য লোয়ার ডেপথস নাটকটি। এক লাইনের গানটি গেয়েছিল নাটকের চরিত্রগুলো। মনে গেঁথে যায় কথাগুলোও। এর বড় কারণ, এই গানের লাইনে পুরো নাটকের গল্পটা লুকিয়ে আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগে শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক পাঠের অংশ হিসেবে নাটক প্রযোজনা করেন। বেশির ভাগ নাটক প্রশংসিত হয়। এবার তাঁরা মঞ্চে এনেছেন ম্যাক্সিম গোর্কির দ্য লোয়ার ডেপথস। তানভীর মোকাম্মেল অনূদিত এ নাটকের নির্দেশনা দিচ্ছেন বিভাগের শিক্ষক তানভীর নাহিদ খান। ৭ মে থেকে নাটমণ্ডলে নাটকটির প্রদর্শনী শুরু। সেদিন থেকে পরপর তিন সন্ধ্যায় চলে নাটক। আজ বৃহস্পতিবার হবে একই সময়ে। কাল শুক্রবার শেষ প্রদর্শনী। অভিনয় করছেন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থীরা।

৬ মে বিকেলে নাটকটি দেখার সুযোগ হয়। আমন্ত্রিত দর্শকদের জন্য বিশেষ প্রদর্শনীটি মুগ্ধ করে। দেয় দুনিয়ার শ্রমজীবী, নিপীড়িত, বাস্তুহারা, মানুষের জীবনযুদ্ধের মুহূর্তগুলোর নাট্যিক অভিজ্ঞতা।

নাটক শুরুর আগে মিলনায়তনটিতে অল্প আলো ছিল। মঞ্চে অন্ধকার। নাটক শুরুর চূড়ান্ত সংকেত বাজার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে হালকা আলো পড়ে। সহজেই বোঝা যায়, এটি এমন ঘর বা কুঠরি, যেখানে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পৌঁছায় না। নির্মল বাতাস প্রবাহের সুযোগ নেই। এখানকার মানুষেরা কেউ চোর, কেউবা জুয়াড়ি। থাকে একজন ব্যর্থ অভিনেতা, পতিতা, তালার মিস্ত্রি, পশম ব্যবসায়ী ও মুচি। খুব দ্রুত এগিয়ে যাওয়া নাটকের সংলাপ আর চরিত্রগুলোর কর্মকাণ্ডে বোঝা যায়, এদের সবারই একসময় বেঁচে থাকার আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল। এখন আছে শুধুই হাহাকার, আর্তনাদ। হারানোর কিছু নেই, পাওয়ারও কিছু নেই। জীবনের লক্ষ্য নেই।

‘আচ্ছা আমরা মরার পরও কি এভাবে নির্যাতন করা হবে, যন্ত্রণা দেওয়া হবে’—নাটকে মৃত্যুশয্যায় তালার মিস্ত্রির স্ত্রী আন্নার প্রশ্নটির যথাযথ উত্তর দেওয়ার সাধ্য কারও ছিল না। কারণ, এই প্রশ্নই সবার ভেতরে। অবশ্য আন্নার অসুস্থতা অন্ধকার কুঠুরির কাউকে বিচলিত করে না, বরং বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। শুধু তা–ই নয়, এখানে জীবন ও মৃত্যুর ব্যবধান এতই কম যে একদিন আন্নার মৃত্যুও অন্যদের তেমন একটা স্পর্শ করে না। বরং একজন বলে ওঠে, আচ্ছা ওর শরীর থেকে কি গন্ধ বের হবে!

অবশ্য এ হাহাকারময় জীবনেও কারও কারও মাঝে প্রেম উঁকি দেয়। ঠিক ঠিক প্রকাশ পায় মানব-মানবীর চিরাচরিত সম্পর্কের প্রকাশ। তাই নাতাশার মতো এক তরুণীকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চায় পেপেল নামের একজন চোর। তাতে ঈর্শাকাতর হয় আরেক নারী।

একদিন এই কুঠুরিতে লুকা নামের এক ভবঘুরে বৃদ্ধ হাজির হয়। যার কাছে দুনিয়াটা সরাইখানা। লোকটা কুঠুরির মানুষদের বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়, মানুষকে ভালোবাসার, মর্যাদা দেওয়ার কথা বলে। তার প্রেরণা অন্যদের মাঝে আশা জাগায়। কিন্তু একসময় কুঠুরির মালিক কস্তিলভের খুন এবং অভিনেতার আত্মহত্যা কুঠরির বাসিন্দাদের আশাকে দুরাশায় পরিণত করে। দুঃখ–কষ্ট ভুলে থাকার উপায় আর থাকে না। জীবন জীবনের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে।

থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের প্রথম নাটক হলেও নির্দেশক তানভীর নাহিদ খানের এটি চতুর্থ নির্দেশিত নাটক। এ নাট্যকলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ২০১৭ সালের শেষের দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। ২০১৮ সালের মার্চ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। ম্যাক্সিম গোর্কির নাটকটি কেন বেছে নিলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, সারা বিশ্বের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় খুবই প্রাসঙ্গিক একটি নাটক দ্য লোয়ার ডেপথস। ম্যাক্সিম গোর্কি তাঁর অমর সৃষ্টিকর্মগুলোর মাধ্যমে তাবৎ দুনিয়ার মানুষের একটি সুন্দর ভবিষ্যতের আশা জাগিয়ে রাখেন, স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখেন প্রাণের পরতে পরতে। ১৯০১ সালে রচিত এই নাটক সময়কে অতিক্রম করেছে, কিন্তু সময় এই নাটককে অতিক্রম করে যেতে পারেনি। কালের ধুলোয় নাটকটি এতটুকুন ম্লান হয়নি, বরং আজকের অধিকার বঞ্চিত মানুষের বাস্তবতাকেও বর্ণনা করে।’

ইতিহাস বলছে, চেখভের উৎসাহে নাটক লেখা শুরু করেছিলেন গোর্কি। লোয়ার ডেপথ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক। এই নাটকের বাণী সে সময় শুধু রাশিয়া নয়, ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ইউরোপে।