মৃণাল সেনের জন্মদিন উদ্যাপন হবে কাল

মৃণাল সেন
মৃণাল সেন

১৪ মে কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের ৯৬তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। এর মধ্যে আছে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী আর তাঁর চলচ্চিত্রকর্ম নিয়ে ‘মৃণাল পাঠ’ শিরোনামে আলোচনা।

আয়োজকদের কাছ থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল ডিজিটাল আর্কাইভে এই আয়োজন করা হয়েছে। এই আয়োজনে থাকছে বেলা তিনটায় মৃণাল সেন নির্মিত চলচ্চিত্র ‘কলকাতা ৭১’-এর প্রদর্শনী, সাড়ে চারটায় মৃণাল সেন নির্মিত চলচ্চিত্র ‘একদিন প্রতিদিন’-এর প্রদর্শনী, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় ‘মৃণাল পাঠ’ শিরোনামে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রকর্ম-বিষয়ক আলোচনা। মৃণাল সেনের জীবন আর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আলোচনা করবেন চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক মাহমুদুল হোসেন, চলচ্চিত্র গবেষক ও লেখক অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ, চলচ্চিত্র সমালোচক জাঈদ আজিজ এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক বেলায়াত হোসেন মামুন।

বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রে বিশ্বব্যাপী কিংবদন্তি হয়ে আছেন তিনজন পুরোধা চলচ্চিত্রকার। তাঁদের অন্যতম হলেন মৃণাল সেন। অপর দুজন হলেন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক কুমার ঘটক। সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক কুমার ঘটক প্রয়াত হয়েছেন। আমাদের মাঝে আছেন মৃণাল সেন।

মৃণাল সেন ১৯২৩ সালের ১৪ মে তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পূর্ব বাংলায় তিনি তাঁর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়ালেখা সম্পন্ন করে দেশভাগের পর পশ্চিম বাংলার কলকাতায় স্থায়ী হন। পরবর্তীকালে তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের যুগ পরিবর্তনের অন্যতম কান্ডারি হয়ে ওঠেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের নবতরঙ্গের প্রধান পুরোধা হিসেবে আজ তিনি নন্দিত হয়ে আছেন। বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্র বিদ্যায়তনগুলোয় মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র এখন অবশ্যপাঠ্য।

মৃণাল সেন স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা পড়াশোনা করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গে যুক্ত হন। চল্লিশের দশকে তিনি আইপিটিএর (ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ তবে তিনি কখনো কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হননি। তিনি কখনো সাংবাদিক, কখনো ওষুধ বিপণনকারী এবং চলচ্চিত্রে শব্দ কলাকুশলী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৯ সালে ‘নীল আকাশের নিচে’ ছবিটি তাঁকে পরিচিতি দিলেও তার আগে তিনি ছবি করেছেন৷ তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘রাতভোর’৷ এই ছবিতে অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার, তখনো তিনি সেভাবে তারকা হয়ে ওঠেননি৷ আবার ১৯৭৬ সালে তাঁর ছবি ‘মৃগয়া’তে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে আবির্ভাব ঘটে মিঠুন চক্রবর্তীর৷ মৃণাল সেনের সর্বশেষ ছবি ‘আমার ভুবন’ মুক্তি পায় ২০০২ সালে। বাংলা ভাষার পাশাপাশি হিন্দি, ওড়িয়া ও তেলেগু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তিনি ১৯৮৫ সালে নির্মাণ করেন ‘জেনেসিস’ নামে একটি চলচ্চিত্র। ছবিটি হিন্দি, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় তৈরি হয়। তিনি ১৯৮১ সালে পদ্মভূষণ লাভ করেন এবং ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান। তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল অবধি ভারতীয় সংসদের সাম্মানিক সদস্যপদ লাভ করেন। ফরাসি সরকার তাঁকে কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব আর্টস অ্যান্ড লেটারস সম্মানে সম্মানিত করেন। আর রাশিয়া তাঁকে অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ সম্মানে ভূষিত করেছে।

২৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও ৪টি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ৬টি চলচ্চিত্রবিষয়ক মৌলিক গ্রন্থও লিখেছেন। ভারতীয় প্যারালাল সিনেমার পুরোধা ব্যক্তি তিনি। গত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে শুরু করে নয়ের দশক এবং শূন্য দশকের পশ্চিম বাংলার সমাজকাঠামোর নানা সংকট থেকেই তিনি তাঁর অধিকাংশ চলচ্চিত্রের বিষয় বেছে নিয়েছেন। তাঁর চলচ্চিত্রসমুদয়, দু-একটি বাদে, তাঁর সময়ে ঘটতে থাকা সমাজ-ইতিহাসের চলচ্চিত্রায়ণই বটে।

রাজনীতির দীনতা, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, সমাজ-সংসারে নারীর অধস্তন অবস্থান, নারীর মনোলোক, ব্যষ্টির নৈঃসঙ্গ্য, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নগরায়ণের অসম্পূর্ণতাজাত নানা সমস্যা, মানবসভ্যতার নানামুখী সংকট, শ্রমিক-কৃষক-আমলা-প্রান্তজন—সব তাঁর চলচ্চিত্রের বিষয়-চরিত্র হয়ে এসেছে।

বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কাহিনির কারণেই মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রের আঙ্গিক সতত নিরীক্ষাপ্রবণ। তাঁর চলচ্চিত্র নির্মিতির ধাঁচে ইতালীয় নব্য বাস্তববাদের অভ্যন্তরীণ উপকরণ ও ফরাসি নবতরঙ্গের প্রভাব পড়েছে; চেখভ্-ব্রেখট্-চ্যাপলিনের গল্প-নাটক-চলচ্চিত্র উপস্থাপনের রীতির উপস্থিতিও টের পাওয়া যায়।

বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের কীর্তিময় জীবনের এক ঐতিহাসিক দিন ১৪ মে। এই দিন তিনি ৯৬ বছরে পা রাখছেন।