ফেসবুকে দেখে বুলবুলের চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন প্রধানমন্ত্রী

মুক্তিযোদ্ধা, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ বুধবার রাতে প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে জুনাইদ আহমেদ বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবরেণ্য গীতিকবি, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাইয়ের ফেসবুকে দেওয়া পোস্ট প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে। সঙ্গে সঙ্গে এই পোস্ট নিয়ে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এরপর স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনি দেশের গুণী এই ব্যক্তিত্বের খোঁজখবর নেন। তিনি এও জানিয়েছেন, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাইয়ের চিকিৎসাসেবা এবং যাবতীয় দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেছেন। তাঁর চিকিৎসায় যা যা করণীয় তিনি সবই করবেন।’

আজ বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল লেখেন, ‘একটি ঘরে ছয় বছর গৃহবন্দী থাকতে থাকতে আমি আজ উল্লেখযোগ্যভাবে অসুস্থ। আমার হার্টে আটটা ব্লক ধরা পড়েছে। এরই মধ্যে কাউকে না জানিয়ে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে সিসিইউতে চার দিন ছিলাম। আগামী ১০ দিনের মধ্যে হার্টের বাইপাস সার্জারি করানোর জন্য প্রস্তুত আছি।’ ফেসবুকের এ পোস্টটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নজরে এলে তিনি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ খবর জানতে ফোন করা হলে তাঁর নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় তাঁর আউটার সার্কুলার রোডের বাসায় গেলে জানা যায়, তিনি এখন আর সে বাসায় থাকেন না। সারা দিন ধরে সংগীতাঙ্গনের অনেককে ফোন করা হলেও তাঁরা কেউই আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের নতুন বাসার ঠিকানা বলতে পারেননি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাত আটটার দিকে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। জানালেন তিনি এখন আফতাবনগরে থাকেন। ঠিকানা নিয়ে তাঁর বাসায় গেলে কথা হয় একমাত্র ছেলে সামির আহমেদের সঙ্গে।

ঢাকার আফতাবনগরের বাসায় বুধবার রাতে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ছবি: মনজুর কাদের
ঢাকার আফতাবনগরের বাসায় বুধবার রাতে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ছবি: মনজুর কাদের

বাবার শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে সামির প্রথম আলোকে বলেন, ‘সপ্তাহখানেক আগে বাবাকে একদম নরমাল একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সাধারণ একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যাই। সেখান থেকে আমাদের দ্রুত জানানো হয়, বাবার মাইল্ড অ্যাটাক হয়েছে। দ্রুত করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি করাতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে আমরা তাঁকে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে নিয়ে যাই। তাঁরা সিসিইউতে ভর্তি করালেন। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানতে পারলাম, তাঁর হার্টে আটটি ব্লক ধরা পড়েছে। এর মধ্যে দুটি ব্লক মেজর। পরামর্শ দিলেন বাবার দ্রুত বাইপাস করাতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে বাবার চিকিৎসাসেবা ও এর যাবতীয় কিছু নিজ দায়িত্বে নিয়েছেন। সন্তান হিসেবে এখন শুধু বাবার সুচিকিৎসা চাইছি। দেশবাসী সবাই আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন, তিনি যেন সুস্থ হয়ে আবার আগের মতো গানে ব্যস্ত হন।’

আহমেদের ইমতিয়াজ বুলবুলের শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিতে সরাদিনই সংগীতাঙ্গনের অনেকে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ফোন বন্ধ থাকার তাঁর সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করতে পারেননি। রাতে তাঁকে দেখতে আসেন গায়ক মনির খান ও সংগীত পরিচালক ইজাজ খান স্বপন।

বুধবার রাতে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে দেখা করতে যান মনির খান ও ইজাজ খান স্বপন। ছবি: মনজুর কাদের
বুধবার রাতে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে দেখা করতে যান মনির খান ও ইজাজ খান স্বপন। ছবি: মনজুর কাদের

বুধবার ফেসবুকে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আরও লেখেন, ‘আমি এখন ২৪ ঘণ্টা পুলিশি পাহারায় গৃহবন্দী থাকি, একমাত্র সন্তানকে নিয়ে। এ এক অভূতপূর্ব করুণ অধ্যায়।’ গৃহবন্দী থাকার কারণ হিসেবে তিনি লিখেছেন, ‘বন্ধুরা, সরকারের নির্দেশে ২০১২ সালে আমাকে যুদ্ধাপরাধীর ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় সাক্ষী হিসেবে দাঁড়াতে হয়েছিল। সাহসিকতার সঙ্গে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে হয়েছিল ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলখানার গণহত্যার সম্পূর্ণ ইতিহাস। ওই গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া পাঁচজনের মধ্যে আমি একজন। হত্যা করা হয়েছিল একসঙ্গে ৪৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে। কিন্তু এই সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে আমার নিরপরাধ ছোট ভাই মিরাজকে হত্যা করা হবে, তা কখনো বিশ্বাস করতে পারিনি। সরকারের কাছে বিচার চেয়েছি, বিচার পাইনি।’

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ফেসবুকে লেখা তাঁর এই স্ট্যাটাসে একদিকে যেমন নিজের মনে জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, পাশাপাশি নিজের চিকিৎসার জন্য কারও কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা চাননি। তিনি লিখেছেন, ‘কোনো সরকারি সাহায্য কিংবা শিল্পী, বন্ধুবান্ধবের সাহায্য আমার দরকার নাই। আমি একাই যথেষ্ট। শুধু অপারেশনের আগে ১০ সেকেন্ডের জন্য বুকের মাঝে বাংলাদেশের পতাকা আর কোরআন শরিফ রাখতে চাই।’

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের এই স্ট্যাটাসের পর দেশের সংগীত জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দ্রুত নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ফেসবুকে অনেকেই এই গুণী মানুষটির চিকিৎসার জন্য এখনই সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি সবাই আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেছেন।

সংগীতজগতে অবদানের জন্য আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে যখন অংশ নেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫ বছর। সত্তরের দশকের শেষ দিকে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ ছবিতে সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তিনি স্বাধীনভাবে গানের অ্যালবাম তৈরি করেছেন এবং অসংখ্য চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন। তাঁর সুরে ও সংগীতে বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের পাশাপাশি এ প্রজন্মের অনেকে গান গেয়েছেন। এঁদের মধ্যে সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আবদুল হাদী, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, আগুন, কনকচাঁপা, মনির খান, জেমস, বাপ্পা মজুমদার, নোলক, রাজীব, কোনাল, সালমা, বিউটি, সাব্বির, কিশোর প্রমুখ।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন। চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করে দুবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। প্রথমটি ছিল ২০০১ সালে ‘প্রেমের তাজমহল’ আর দ্বিতীয়টি ছিল ‘হাজার বছর ধরে’ ছবির জন্য।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরের উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আছে ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সেই রেললাইনের ধারে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না’, ‘একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘আমি তোমারি প্রেমও ভিখারি’, ‘ও আমার মন কান্দে’, ‘আমার একদিকে পৃথিবী একদিকে ভালোবাসা’, ‘আমি তোমার দুটি চোখে দুটি তারা হয়ে থাকব’, ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’, ‘পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে যেন পেয়েছি’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়, হাজার বছর আগেও বুঝি ছিল পরিচয়’, ‘ওই চাঁদ মুখে যেন লাগে না গ্রহণ’, ‘বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম’, ‘আম্মাজান আম্মাজান’, ‘এই বুকে বইছে যমুনা’, ‘সাগরের মতোই গভীর, আকাশের মতোই অসীম’, ‘প্রেম কখনো মধুর, কখনো সে বেদনা বিধুর’, ‘আমার সুখেরও কলসি ভাইঙ্গা গেছে লাগবে না আর জোড়া’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে’, ‘কী আমার পরিচয়, ঠিকানা কী জানি না’, ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’, ‘জীবনে বসন্ত এসেছে, ফুলে ফুলে ভরে গেছে মন’, ‘আমার হৃদয় একটা আয়না’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা, হৃদয়ে সুখের দোলা’, ‘তুমি আমার এমনই একজন, যারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না’, ‘একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল’, ‘এই জগৎ সংসারে তুমি এমনই একজন’, ‘জীবন ফুরিয়ে যাবে ভালোবাসা ফুরাবে না জীবনে’, ‘অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন’, ‘নদী চায় চলতে, তারা যায় জ্বলতে’, ‘ও ডাক্তার, ও ডাক্তার’, ‘চিঠি লিখেছে বউ আমার’ ও ‘আট আনার জীবন’।