৫ টুকরো কান

দিন পাঁচেক কেটে গেল। কানের কোয়াজেতের ধারে এখন আর গত দুই সপ্তাহের মতো এত ভিড় নেই। রীতিমতো খাঁ খাঁ একটা অবস্থা। পালে দো ফেস্তিভালের লালগালিচার তেজও কমে গেছে। তবে উৎসবের উত্তেজনায় কিন্তু এখনো ভাটা পড়েনি। ৭১তম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এখনো সিনেমাপ্রেমীদের আড্ডা-আলোচনার অন্যতম খোরাক। ২০ মে অর্থাৎ ৭১তম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হওয়ার পরদিন যখন শহরটা ছেড়ে আসি, তখনো নিস শহরের বিমানবন্দরে বসে কয়েকজন আলাপ করে যাচ্ছিলেন উৎসবের সবচেয়ে বড় সম্মান জেতা শপলিফটার্স ছবিটি নিয়ে। সেই আড্ডায় উঠে আসে কানে দেখানো সিনেমাগুলো নিয়ে নানা প্রসঙ্গ। এভাবেই কান উৎসব ফুরিয়ে গেলেও যে আমেজ ছড়িয়ে গেল উৎসবটি, তার ঘোর কাটছে না এখনো। এই ঘোরে থাকতে থাকতেই চলুন আজও উৎসবের এমন কিছু দিকে নজর রাখি, যা এ আয়োজনকে অন্য বছরের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে।

এশিয়া আর্জেন্টোর শক্তিশালী বক্তৃতা

কান চলচ্চিত্র উৎসবকে ঘিরে অভিনেত্রী এশিয়া আর্জেন্টোর স্মৃতি খুব একটা সুখকর নয়। তাই গত শনিবার সন্ধ্যায় ৭১তম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে এই অভিনেত্রী মঞ্চে উঠলে পুরো মিলনায়তনে এক ভারি আবহ তৈরি হয়। তিনি এসেছিলেন উৎসবের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার তুলে দিতে। মঞ্চে উঠতেই এশিয়া আর্জেন্টো ফিরে যান ১৯৯৭ সালে অন্ধকার এক রাতে, যে রাতে হলিউডের প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টিন তাঁকে ধর্ষণ করেছিলেন। নিজের বক্তৃতায় এশিয়া বলেন, ‘১৯৯৭ সালে এই কানেই আমাকে ধর্ষণ করেছিল হার্ভি ওয়াইনস্টিন। আমার বয়স তখন ২১। এই উৎসবটা হার্ভির কাছে ছিল একটা শিকারের জায়গার মতো। আজকের দিনে আমি একটি ভবিষ্যদ্বাণী করতে চাই—হার্ভি ওয়াইনস্টিন আর কোনো দিন এই উৎসবের অংশ হতে পারবে না। সে আজীবন অপমান আর অসম্মান নিয়ে বাঁচবে। যারা একসময় তাকে সম্মান করত, তার পাপগুলো ঢেকে রাখত, তারাই একঘরে করে রাখবে তাকে। এমনকি আজকেও এখানে বসা অনেকে নারীদের ওপর চলতে থাকা নিপীড়নের জন্য জবাবদিহি করতে প্রস্তুত থাকে। কারণ, তোমরা যারা নিপীড়ন করছ, তাদের এই আচরণ আর কেউ সহ্য করবে না, কোনো কর্মক্ষেত্রেই এটা আর সহ্য করা হবে না। তোমরা কে কেমন, তা আমরা জেনে গেছি। তাই আমার সঙ্গে যা হয়েছিল, তা আর কারও সঙ্গে হতে দেব না, সহ্য করব না।’

এশিয়ার এই বক্তৃতা শেষ হতেই তুমুল করতালিতে ফেটে পড়ে গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়ের।

সুভাষ ঘাইয়ের অনুপ্রেরণায় গুরু ঋত্বিক ঘটক

গত বৃহস্পতিবার পালে দো ফেস্তিভাল থেকে বেরিয়ে গন্তব্য ভিলেজ ইন্টারন্যাশনালে ভারতের প্যাভিলিয়ন। ভিলেজ ইন্টারন্যাশনালে বাংলাদেশের কোনো প্যাভিলিয়ন নেই। তাই ভারতের প্যাভিলিয়নে গেলে মার্শে দ্যু ফিল্মে অংশ নেওয়া কিছু চেনা মুখ চোখে পড়ে। তাই সেখানে বার দুয়েক যাওয়া হয়েছে। ১৭ মে সেখানে যেতেই জানা যায় ভারতীয় চিত্র পরিচালক সুভাষ ঘাই সেখানে আসছেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর রাম লক্ষণ, খলনায়ক, পরদেশ, তাল—ছবির সেই নির্মাতার সঙ্গে দেখা। অনানুষ্ঠানিক আলাপে তিনি জানালেন বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশকে ঘিরে তাঁর কিছু কথা। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘ঋত্বিক ঘটক আমার গুরু। জীবনের অনেক বড় সৌভাগ্য যে আমি তাঁর মতো এক গুণী সৃষ্টিশীল ব্যক্তির সান্নিধ্য পেয়েছি। আমার অনেক ছবির অনেক কাজেই তাঁকে, তাঁর কাজের ধরনে অনুপ্রেরণায় রেখে করেছি। তাঁর বলা কথা এখনো আমার মনে আছে।’ সুভাষ ঘাইয়ের ইচ্ছা একদিন তিনি বাংলাদেশে আসবেন। ঋত্বিক ঘটকের দেশটাকে ঘুরে দেখে যাবেন।

এবারের কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এসে এই ভারতের প্যাভিলিয়নেই সুভাষ ঘাই তাঁর নতুন ছবির ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর পরের ছবির নাম হব ওশো, আধ্যাত্মিক গুরু ওশোর জীবনী নিয়ে এ ছবি বানাবেন তিনি।

ফিলিস্তিনের সঙ্গে তারকারা

২০১৮ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসব অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক ছিল। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু, অস্থিরতা ও বিপ্লব এ বছর কান উৎসবকে উত্তেজনায় অস্থির করে রেখেছে। হোক তা যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার পুতিন কিংবা ইরানের জাফর পানাহির গৃহবন্দী থাকা—কান এবার এসব ইস্যুকে প্রাধান্য দেওয়ায় অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

তবে এসবের ভিড়ে একটি প্রসঙ্গ এবার অনেকের হৃদয়কেই ছুঁয়ে গেছে, সেটি হলো ফিলিস্তিনের প্যাভিলিয়ন ঘিরে সবার আগ্রহ। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশও যে সিনেমার সবচেয়ে বড় এ বাজারে সব প্রতিকূলতা ঠেলে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের তুলে ধরতে পারে, এটা ফিলিস্তিনির স্টলে না গিয়ে বোঝার উপায় নেই। এটিই কানের সিনেমা বাজার ‘মার্শে দ্যু ফিল্মে’র ভিলেজ ইন্টারন্যাশনালে তাদের দেওয়া প্রথম ‘কান্ট্রি প্যাভিলিয়ন’। ফিলিস্তিন ফিল্ম ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্যাভিলিয়নটি সাজানো হয়েছে।

১৫ মে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অষ্টম দিনে ফিলিস্তিনের এই প্যাভিলিয়নে ছিল ভিন্নধর্মী এক আয়োজন। সেখানে ১৪ মে গাজা সীমান্তে ইসরায়েলের সেনাদের হামলায় নিহত ৬০ জনের প্রতি সম্মান জানানো হয়। প্যাভিলিয়নের সবাই ফিলিস্তিনের পতাকা অর্ধনমিত রেখে ১ মিনিট নীরবতা পালন করেন। সেখানে ফিলিস্তিনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে হলিউডের অভিনেতা বেনিসিও দেল তোরোও কর্মসূচিতে অংশ নেন।

হ্যাপি অ্যাজ লাৎজারো ছবির দৃশ্য
হ্যাপি অ্যাজ লাৎজারো ছবির দৃশ্য

না থেকেও নেটফ্লিক্সের বাজিমাত

উৎসবের সমাপনী দিনে সেরা চিত্রনাট্যের জন্য পুরস্কারজয়ী ছবি হ্যাপি অ্যাজ লাৎজারোর পরিচালক অ্যালিস রোরওয়াচারের কাছে সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক আচমকা প্রশ্ন করে বসলেন, ‘এবারের উৎসবে তো নেটফ্লিক্স নিষিদ্ধ। কিন্তু আপনার ছবি নাকি আপনার প্রযোজকেরা নেটফ্লিক্সের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন? তাহলে এ ছবিটি তো পুরস্কার জেতার যোগ্যতা হারাল, তাই নয় কি?’ সাংবাদিকের এমন তীক্ষ্ণ প্রশ্নে কপালে খানিক ভাঁজ পড়ল অ্যালিসের। এরপর নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আপনার কাছ থেকে খবরটি প্রথম জানলাম। ধন্যবাদ আপনাকে। আসলে পরিচালক হিসেবে গত কয়েক দিন উৎসবে ছবির প্রদর্শনী নিয়ে প্রচণ্ড চাপে ছিলাম আমি। এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। তবে ছবিটির প্রদর্শনীর ব্যাপারে আমার পাশাপাশি আমার প্রযোজকেরাও সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তাঁদের দিক থেকে কোনো আলাপ হলে আমি জানতাম ব্যাপারটা। আপাতত আমার জানা মতে, এমন কিছু ঘটেনি।’

পরিচালক পুরস্কার জেতার পর সংবাদ সম্মেলনে নেটফ্লিক্সের সম্পৃক্ততাকে এভাবেই এড়িয়ে যান। তবে দিন না পেরোতেই হ্যাপি অ্যাজ লাৎজারোর সঙ্গে নেটফ্লিক্সের

সম্পৃক্ততার খবর সত্যতা পায়। ছবিটি পরিবেশনের স্বত্ব কিনে নিয়েছে অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের সাইট নেটফ্লিক্স। অর্থাৎ ৭১তম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এ ছবিটি প্রদর্শনের পর আর কোনো প্রেক্ষাগৃহে নয়, ছবিটি অনলাইনে নেটফ্লিক্সে স্ট্রিম করে দর্শকদের দেখতে হবে। আর এই অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের বিরুদ্ধেই ছিল কান উৎসব কর্তৃপক্ষ। এ জন্যই তো এত বিতর্কের মুখে পরে নেটফ্লিক্সকে নিষিদ্ধ করা। কিন্তু এরপরও কি থামানো গেল? খেলারাম তো খেলেই গেল, শেষে এসে বাজিমাত করে গেল।

‘আমরা বাংলাদেশের কাছে হেরে গেছি’

হাঁটতে হাঁটতে কানের ভিলেজ ইন্টারন্যাশনালের নেদারল্যান্ডসের প্যাভিলিয়নে যাই। সেখানে ঢুকতে এক তরুণী এসে ‘গুড ইভিনিং’ বলে স্বাগত জানিয়ে পরিচয় জানতে চাইলেন। বাংলাদেশ থেকে এসেছি—এটা জানতে পেরেই সেই তরুণীর চোখ-মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেল। এরপরই তাঁর বলা প্রথম কথাটি ছিল, ‘আমরা তোমাদের বাংলাদেশের কাছে হেরে গেছি। তোমরা জিতে গেছ।’ একটু বিস্ময় নিয়েই সেই তরুণীর কাছে জানতে চাই, ‘কিসে হেরে গেছি?’ এরপর তিনি বললেন বিস্তারিত। প্যাভিলিয়নের সোফায় বসে তাঁর আক্ষেপের গল্প শোনা হলো। স্যান্ডি নামের সেই তরুণী বলছিলেন ফিয়াফ সম্মেলনের কথা। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম আর্কাইভস (ফিয়াফ) প্রতিবছর একটি করে বিশাল পরিসরে সম্মেলনের আয়োজন করে, নাম ফিয়াফ কংগ্রেস। গেল এপ্রিলে চেক রিপাবলিকের প্রাগ শহরে হয় ফিয়াফের ৭৪তম কংগ্রেস। সেখানে অংশ নেওয়া দেশগুলো ভোট দিয়ে ৭৭তম ফিয়াফ সম্মেলনের ‘আয়োজক দেশ’ হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচিত করে। বাংলাদেশ সেই নির্বাচনে পায় ৪৬টি ভোট। আর বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নেদারল্যান্ডস পায় ৩৭টি। তারা হেরে যায় বাংলাদেশের কাছে।

স্যান্ডি খুব আফসোস করেই বলছিলেন, ‘আমরা সম্মেলন আয়োজনের জন্য অনেক বছর ধরে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে আসছিলাম। ভোটের প্রথম রাউন্ডে আমরা বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়েও ছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে গিয়ে বাংলাদেশ জিতে যায়। আমরা কোনো দিন ধারণাও করিনি যে আমরা বাংলাদেশের কাছে হেরে যাব। যাক গে, ব্যাপার না। আমরা আগামীবার আবার চেষ্টা করব। ফিয়াফ সম্মেলন সিনেমার ঐতিহ্য, সংরক্ষণ আর চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নতির জন্য অনেক বড় একটি ব্যাপার। আশা করি, তোমরা এত বড় সম্মেলন আয়োজনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।’

বাংলাদেশ ফিয়াফ সম্মেলনের জন্য কতটা প্রস্তুত, এটা সময়ই বলে দেবে। আগামী বছর এই সম্মেলন আয়োজিত হবে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। ২০২০ সালে ৭৬তম ফিয়াফ সম্মেলনের আয়োজক দেশ মেক্সিকো। আর ২০২১ সালে ৭৭তম সম্মেলনটি হবে বাংলাদেশে, ঢাকায়। এতে প্রতিবছরই বিশ্বের বড় বড় চলচ্চিত্র সংরক্ষণকারী সংস্থাগুলো অংশ নেয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই সম্মেলনে ২০২১ সালে আয়োজন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ।