হুটহাট মন্তব্যে শিরোনাম হওয়াতে বাহাদুরি নেই: নিপুণ

নিপুণ
নিপুণ
>সোমবার গভীর রাতে ফেসবুকে কয়েকটি ছবি পোস্ট করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রনায়িকা নিপুণ। ছবিতে দেখা যায়, তিনি ঠেলাগাড়িতে চড়ে মালামাল নিয়ে যেন কোথায় যাচ্ছেন। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে মঙ্গলবার দুপুরে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। বললেন, ‘নাটক, টেলিছবি আর চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে কত কিছু যে করতে হয়!’ এবার ঈদের টেলিছবিতে অভিনয় আর অন্যান্য বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বললেন নিপুণ।

আপনি ব্যবসা নিয়ে বেশি ব্যস্ত। টেলিছবিতে অভিনয়ের জন্য সময় বের করলেন কীভাবে?
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি আমি টেলিভিশন নাটকে টুকটাক কাজ করছি। বিশেষ দিবসে এই নাটকগুলো প্রচারিত হয়েছে। ঈদ কিংবা অন্য উৎসবে নাটকে অভিনয়ের প্রস্তাব পাই। খুব পরিচিত পরিচালকেরা আগে থেকেই বলে রাখেন। তারপর সময় বের করেছি।

এবার ঈদে কয়টি টেলিছবিতে অভিনয় করেছেন?
দুটি টেলিছবি। একটির নাম ‘মোহাব্বত ব্যাপারী ২’ আর অন্যটি ‘একটুস খানি প্রেম’। নির্মাতারা হলেন এস এ হক অলিক ও সাজ্জাদ হোসেন দোদুল। দুটি টেলিছবি কমেডি ধাঁচের। অলিক ভাইয়ের নাটকে আমি আর নাদিয়া বোনের চরিত্রে অভিনয় করেছি। ঠেলাগাড়িতে করে বাসা বদল করার দৃশ্যে শুটিং করেছি। গতকাল সোমবার সারা দিন উত্তরায় শুটিং করেছি।

ঠেলাগাড়িতে আগে কখনো উঠেছেন?
না, অভিনয়ের জন্য কত কিছুই যে করতে হয়! ঠেলাগাড়িতে অনেক সময় বসে থাকতে হয়েছে। লম্বা শট ছিল। নাটক আর চলচ্চিত্রের জন্য নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। শুরুতে কিছুটা ভয় পেলেও ওঠার পর আর পাইনি।

ছোট পর্দায় তো কাজ করছেন, বড় পর্দায় করছেন না কেন?
ভালো কোনো চরিত্র পাচ্ছি না। ভালো ছবির প্রস্তাবও নেই। এখন যদি ভালো মানের ছবিতে কাজ না করি, যে ভালো কাজগুলো আগে করছি, সেগুলো হারিয়ে যাবে।

আপনার দৃষ্টিতে চলচ্চিত্রের এখনকার অবস্থা কেমন মনে হচ্ছে?
জানি না। আগের মতো যে নাই, তা নিশ্চিত। আমি যখন ২০০৬ সালে ছবিতে অভিনয় শুরু করেছিলাম, তখন ঈদে ১০-১২টি ছবি মুক্তি পেত। এরপর কমতে কমতে সাত-আটটি। আর এখন তো দু-তিনটি ছবি মুক্তি দিতে ঘাম ঝরে। এখন আন্তরিকতার জায়গা অনেক কম। সবাই সবার দোষ খোঁজে। কে কী করল, না করল—এসব। আসলে দোষ না খুঁজে সিনিয়র-জুনিয়র যাঁরা আছেন, সবাই মিলে যদি কাজে মনোযোগী হয়, তাহলে কাজের সংখ্যা বাড়বে। কাজগুলো ভালো হবে। কদিন আগে শুনলাম, পূর্ণিমা আপু ‘দহন’ ছবিতে কাজ করছেন না! তাঁর মতো একজন অভিজ্ঞ শিল্পী যদি নতুন করে কাজ শুরু করতেন, ভালো হতো।

তিনি বলেছেন, ছবিতে তাঁর কাজ শুরুর খবর প্রচারমাধ্যমে সঠিকভাবে আসেনি।
পূর্ণিমা আপু ছবিতে অভিনয় করছেন শুনে খুশি হয়েছিলাম। ‘দহন’ ছবিতে অভিনয় করতে বাঁধন প্রথমে চুক্তিবদ্ধ হন, এটা তো মিথ্যা না। সমস্যার কারণে বাঁধন সরে গেছেন। এরপর হয়তো পূর্ণিমা আপুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। সিনিয়ররা কিন্তু অভিজ্ঞতায় অনেক এগিয়ে। যে কারণ দেখিয়ে তিনি ছবিটি ছেড়ে দিয়েছেন, তা আমার কাছে যুক্তিসংগত মনে হয়নি। সবাই একটু গুটিয়ে যাওয়াতে চলচ্চিত্রে নানা সমস্যা দেখা যাচ্ছে।

নিপুণ
নিপুণ

শিল্পীদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে?
একদম তাই। আমি কিন্তু এ কথাটাই বলতে চাচ্ছি। আমাকে কেউ যখন জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা এই ছবিটি করব কি না, এখানে তো অমুক-তমুক আছে। আমি বলি, কে আছে না আছে, এত কিছু দেখার দরকার নেই। গল্পে তুমি তোমার চরিত্র ঠিকমতো বুঝে পেয়েছ কি না, তা দেখলেই হয়। তোমার দরকার ভালো একটি কাজে অংশ হওয়া। তুমি ভালো করলে, সেখান থেকে সবাই তোমাকে খুঁজে নেবে। এ কথাটি হয়তো এখন কেউ বলে না। সবাই বলে, না না, কোরো না। এখানে আরেকজন আছে, আরেকজনকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে। আসলে এত কিছু ভাবার দরকার নেই।

শিল্পীদের মধ্যে বিভাজন আগে ছিল না?
এটা সব সময় ছিল। কিন্তু কখনোই জনসমক্ষে আসেনি। পর্দায় নিজেকে উপস্থাপনের জন্য একটি অন্য রকম প্রতিযোগিতা ছিল। সবাই আবার একসঙ্গে আড্ডা দিত। সবাই সবার স্বার্থ নিয়ে ভাবলেও তা পাবলিককে বুঝতে দিতেন না। আমার কেন জানি মনে হয়, চলচ্চিত্রে সাম্প্রতিক সময়ে শিল্পীদের মধ্যে যে জটিলতা এবং মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে গেছে, তার শুরুটা হয় অপু বিশ্বাসের সন্তানসহ গণমাধ্যমে হাজির হওয়ার পর। এরপর ছিল চলচ্চিত্রশিল্পী সমিতির নির্বাচন। এরপর থেকে না সব কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যায়। আমি নিশ্চিত, কেউ না কেউ পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে; যা চলচ্চিত্রের বৃহত্তর স্বার্থে মোটেও ঠিক না।

কেউ কলকাঠি নাড়লে শিল্পীদের কেন নড়তে হবে?
আমার বক্তব্যও তাই। কেউ যদি কাউকে প্রভাবিত করতে চায়, তাহলে আমি কেন তার দ্বারা প্রভাবিত হব। যাকে নিয়ে কথা বলতে হবে, তার সঙ্গে দেখা হলে তারই সামনে সমস্যার কথাগুলো তুলে ধরব। এত দিনের কাজের সম্পর্কে দাবিতে আমরা সবাই তা বলার অধিকার রাখি। কিন্তু হুটহাট মন্তব্য করে সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হওয়ায় কোনো বাহাদুরি নেই। এখন নিজেদের মধ্যে যা কিছুই হয়, সবাই তা ফেসবুকে দিয়ে দেয়। এতে শিল্পীরা কিন্তু সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছেন।

এভাবেই কি চলতে থাকবে?
রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ-অভিমান যা-ই থাকুক, বিষয়টিকে সঠিকভাবে সামাল দেওয়া উচিত। আমরা নিজেদের কথাগুলো যেন নিজেদের চার দেয়ালের ভেতরেই রাখি। কাজগুলোকেই যেন সাধারণের সামনে তুলে ধরি। যে ছবিতে অভিনয়ের কারণে সবাই আমাদের ভালোবাসে, সম্মান করে, আলাদা চোখে দেখে—সবাই যেন সেই ছবিতে অভিনয়ে মনোযোগী হই।

নিপুণ
নিপুণ

এসব সমস্যার সূত্রপাত কবে থেকে বলে মনে করেন?
চলচ্চিত্রে গত কয়েক বছরের মধ্যে শাকিব খান ও অপুর বিষয়টি নিয়ে এত কাদা-ছোড়াছুড়ি হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। শাকিব পক্ষ এবং শাকিববিরোধী পক্ষ—এই ব্যাপারগুলোকে ঠান্ডা না করে উল্টো বাতাস দিয়েছে, যা মোটেও ঠিক হয়নি। একটি মানুষ যখন কাজ করবে, অনেক বেশি জনপ্রিয়তায় প্রতিপক্ষ থাকাটা স্বাভাবিক। প্রতিযোগিতাকে কেন আমি ব্যক্তিগত আক্রোশে পরিণত করব! শাকিব ও অপুর বিষয়কে চলচ্চিত্রের একটা পক্ষ ব্যক্তিগত আক্রোশে কাজে লাগিয়েছে।

শাকিব খানকে নিয়ে কেন এত সমস্যা?

শাকিব অনেক জনপ্রিয় একজন তারকা। আমি যখন এক যুগ আগে অভিনয় শুরু করি, তখন থেকেই সে জনপ্রিয়। চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার সময়ও আমরা যখন কাজ করেছি, তখন অনেক কষ্ট হয়েছে। মান্না ভাইকে তাড়াতাড়ি হারালাম। ২০০৮ সালে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তারপর থেকে কিন্তু শাকিবকে একা লড়তে হয়েছে। একটা ইন্ডাস্ট্রি একাই টেনে নিয়ে গেছেন, দেশের দর্শক তাঁকে সেরাদের সেরা করেছেন, এটা দিবালোকের মতো সত্য। অস্বীকার করেও কোনো লাভ নেই। এটা অনেকের চক্ষুশূল হয়েছেন।

শাকিব খানের নিজের কোনো ভুল ছিল?

যখন কেউ তারকা হবে, তাঁর কাছে নাম-যশ-টাকা একসঙ্গে আসবে, তখন তাঁকে কিছু ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। শাকিব কিছু ব্যাপারে সতর্ক ছিল না। খুব সম্ভবত সে তাঁর বন্ধু চেনেনি, শত্রুও চেনেনি। তাঁর কোনটা করা উচিত, কোনটা করা উচিত নয়, তা বুঝতে পারেনি। এত কাজের ভিড়ে সে বুঝতে পারেনি, কোনটা তাঁর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ভুলগুলো যা ছিল, তা তাঁকে ডেকে এনে বললেই হতো। অপুরও অনেক কিছুতে ভুল ছিল।

কেমন সেটা? 

আমার সন্তান কিন্তু আমাকেই লালন-পালন করতে হবে। বাইরের কেউ এসে সংসার চালিয়ে দিয়ে যাবে না। সন্তানকে লালন-পালন করে দিয়ে যাবে না। ফেসবুকে সর্বোচ্চ, কেউ কেউ বলবেন, ‘আহা, এটা কীভাবে হলো’, ‘উহু, এটা কীভাবে হলো!’ দিনশেষে কিন্তু সবকিছু আমাকেই করতে হবে। সবাই বাইরে থেকে মজা নেবে।

চলচ্চিত্রে তাহলে কেউ কেউ মজা নেয়?
চলচ্চিত্র খুবই অস্থিরতা মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি না সামনে কী যে হবে। আজকে টেলিছবি ‘মোহাব্বত ব্যাপারী ২’ চোখ বন্ধ করে কেন করেছি, কারণ এস এ হক অলিককে আমি চিনি। আমি দোদুল ভাইকেও চিনি। কিন্তু ইদানীং আমাদের চলচ্চিত্র খারাপ মানুষে ভরে গেছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই অস্থিরতার মধ্যে একটি গ্রুপ, যাদের কাজ নেই, তারা ভিন্ন উদ্দেশ্য হাসিল করে যাচ্ছে। যার মাশুল গুনতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। চলচ্চিত্রের বদনাম হচ্ছে ঠিকই, ব্যক্তিস্বার্থ আদায় করেই যাচ্ছে। আমি চলচ্চিত্রের মানুষ হিসেবেই পরিচিত থাকব, কারণ এই অভিনয়ের কারণেই আমি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি। এটা আমার জায়গা। অভিভাবকত্বের কথা বলছি ঠিকই, কিন্তু কোনো অভিভাবক নেই এখন। সবই লোক দেখানো।

তাহলে এত সংগঠন কী করছে?
আমি জানি না। এর উত্তর আমার জানা নেই। শুধু একটি কথা বলতে চাই, আমরা সবাই সিনিয়র হচ্ছি। সবার পরিবার আছে। দায়িত্ব বেড়েছে। কাদা ছোড়াছুড়ির ব্যাপারগুলো যেন ফেসবুকে কম লিখি।

ঈদের টেলিছবির কাজের ফাঁকে ছবি তোলা
ঈদের টেলিছবির কাজের ফাঁকে ছবি তোলা

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির ইফতারে নাকি মৌসুমী ও ওমর সানীকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি।
আমিও শুনেছি। এটা খুবই অন্যায়। আমি বারবার বলছি, প্রতিযোগিতা হবে পর্দায়। আমার অভিনয় যাতে ভালো হয়, গানের দৃশ্যায়ন যাতে সুন্দর হয়, সেদিকে প্রতিযোগিতা হতে হবে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস লিখতে হলে মৌসুমী আর ওমর সানীকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁরা আমাদের অগ্রজ। মানুষের পাশাপাশি শিল্পীদের সবার কাছে এই দম্পতির গ্রহণযোগ্যতা আছে, তাঁদের দাওয়াত না দেওয়ার ব্যাপারটি দুঃখজনক। মৌসুমী আপু ও সানী ভাইয়ের সঙ্গে আমার কী হলো না হলো, তার কারণে আমি দাওয়াত কার্ড দেব না, তা আসলেই দুঃখজনক। শিল্পী সমিতিকে ব্যক্তিগত রেষারেষিতে না গিয়ে চলচ্চিত্রের ভালো কীভাবে করা যায়, তা নিয়েই ভাবতে হয়।

শাকিব খান নিয়ে আপনার মূল্যায়ন বলুন।
কিছুদিন আগে শাকিবের ‘ভাইজান এলো রে’ ছবির ট্রেলার দেখলাম। এরপর গানও দেখলাম। এত মানসিক চাপ, পারিবারিক চাপ, অনেক ঝড় তার ওপর দিয়ে গেছে—অনেক কিছুর পরও শাকিব খান কিন্তু ক্যামেরার সঙ্গে কোনো আপস করে না। এখান থেকে অনেকেরই অনেক কিছু শেখার আছে। এটা দেখে অনেকেরই বোঝা উচিত, আমাদের যার ওপর দিয়ে সমস্যা যাক না কেন, পর্দায় যেন তা বুঝতে না দিই। এমনকি ব্যক্তিগত বিষয়গুলো জনসমক্ষে না আনি। একটি ছবিতে প্রযোজকের অনেক টাকা লগ্নি হয়। তাই দর্শকের ছবি যেন দর্শকের কাছে যাওয়ার পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করে দেওয়া হয়। শাকিবের কলকাতার ছবিগুলো কিন্তু অন্য রকম।

কেন এমনটা মনে হয়?
আমরা শিল্পী, কাদামাটির মতো। পরিচালক আমাদের যেভাবে তৈরি করবেন, সেভাবে নিজেরা তৈরি হব। এটা পুরোপুরি পরিচালকের যোগ্যতা। আমার কাজ হচ্ছে, পরিচালকের নির্দেশমতো শুধু শট দেওয়া। শাকিব খান কিন্তু বাংলাদেশের ছেলে, কলকাতায় কাজ করে সুনাম অর্জনের মধ্য দিয়ে সেখানে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল হচ্ছে। আমার শুধু মনে হয় যে সবার ওর প্রশংসা করা উচিত। উৎসাহ দেওয়া এবং আরও ভালো কাজের পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। তাকে দেখে বাংলাদেশের আরও দশজন যদি উৎসাহিত হয়, তাহলে দেশেরই লাভ।