বারী সিদ্দিকীর মেয়ে হিসেবে আমার জীবন ধন্য

বাবা বারী সিদ্দিকীর সঙ্গে এলমা সিদ্দিকী
বাবা বারী সিদ্দিকীর সঙ্গে এলমা সিদ্দিকী
>গত বছরের ২৪ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন সংগীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী। তাঁর মেয়ে এলমা সিদ্দিকীও গান করেন। ১৭ জুন বাবা দিবস উপলক্ষে এলমা সিদ্দিকী তাঁর বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন।

বাবার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। কোনটা রেখে কোনটা বলব। এটা সম্ভবত সব বাবার সঙ্গে সন্তানের থাকে। আমার বাবার সঙ্গে বেশি স্মৃতি জমেছে ২০১২ সাল থেকে। ওই সময় থেকেই বাবার সঙ্গে নানা ধরনের কনসার্টে যেতাম গান গাওয়ার জন্য। অনেক আয়োজকই জানতেন আমি গান করি। তাই আমন্ত্রণ আসত। তবে বাবার সঙ্গেই বেশি যাওয়া হতো। একটা ঘটনা মনে আছে। বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে চাঁদপুর ক্লাবে গান গাওয়ার জন্য গিয়েছিলাম। তখন দেখেছি বাবাকে কতটা সমাদর করছে সবাই। কতটা ভালোবাসেন। তাদের আয়োজন দেখে মনে হয়েছে, যেন ঘরে নতুন জামাই এসেছে। ইলিশ মাছের পাশাপাশি ওনার জন্য আস্ত খাসি রান্না হয়েছিল সেদিন। খাসির জন্য আমার এই ঘটনা মনে আছে এমন নয়, মনে আছে অন্য কারণে। সেদিন বাবার সঙ্গে গান গাইতে গিয়ে সবার এত ভালোবাসা পেয়েছি যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। সবাই আমাদের বাবা-মেয়েকে ঘিরে অটোগ্রাফ ও ছবি তুলতে ভিড় করেছে। মনে হয়েছে বারী সিদ্দিকীর মেয়ে হিসেবে জীবন ধন্য। ওই দিনটার কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।

আমার বাবা খুব পরিকল্পিত জীবন যাপন করতেন। সময় মেনে চলতেন। সব জায়গায় ঠিক সময়ে পৌঁছে যেতেন। একবার হয়েছে কি, দেশের মধ্যে কোনো একজন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ওনার মিটিং ছিল। বাবার পৌঁছতে দুই-তিন মিনিট দেরি হয়ে যায়। রাষ্ট্রদূত চলে যান। মিটিংটা আর হয় না। তারপর থেকে দেখেছি সব জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ের আগে পৌঁছতেন বাবা। আমার বাবা ছিলেন একটা বইয়ের মতো। বই পড়লে যেমন অনেক কিছু জানা যায়, বোঝা যায়। তেমনি আমার বাবার সঙ্গে সময় কাটানো মানে অনেক কিছু জানা ও বোঝার সুযোগ পাওয়া। যেমন দুইটা উদাহরণ দিই। আমি তো ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেছি। উনি প্রতিবারই বিমানবন্দরে আমাকে রেখে যেতেন। প্রতিবারই বলতেন, ‘ফ্লাইটের কমপক্ষে তিন ঘণ্টা আগে বাসা থেকে বের হবে। আর সব সময় কাছে পাসপোর্ট, টিকিট ও টাকা রাখবে। এই তিনটা জিনিস থাকলে পৃথিবীর কোথাও তুমি আটকাবে না।’

আমার বাবা প্রায়ই আমাকে বলতেন, তুমি যত কিছুই করো, সবার আগে নিজের পায়ের নিচে মাটিটা খুব জরুরি। এমন গায়কের সন্তান হওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই অনেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে গানের অ্যালবাম ও গান গাওয়ার অনুরোধ করত। বাবা তাদের সব সময় বলতেন, ‘ওর পায়ের নিচে আগে মাটি হোক। তারপর গাইবে। সবার আগে পড়াশোনা।’ তখন আমার বারবার মনে হতো, বাবা এত পড়াশোনার কথা কেন বলেন। কী দরকার। কিন্তু এত দিনে এসে মনে হয়, উনিই সঠিক ছিলেন। এই উপদেশটা কাজে লাগালে জীবনে আর পেছনে ফিরতে হবে না।

বাবার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে অসুস্থ হওয়ার আগে। ওনার শোবার ঘরে বসে গল্প করছিলাম। আমাকে বললেন, ‘তুমি তো দেশের বাইরে পড়েছ। একটা দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনেছ। আরও দেশে যাও। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানো। কারণ, একটা দেশের সংস্কৃতি যদি নিজের মধ্যে ধারণ করো, তাহলে অনেক কিছুই তোমার জন্য সহজ হবে।’ আমি বাবার কথা রাখার চেষ্টা করি। মাঝেমধ্যেই ঘুরতে বের হই। তবে বাবার কাছ থেকে পাওয়া আরও একটা জিনিস মেনে চলি। তা হলো, কমিটমেন্ট। বাংলায় যাকে বলে প্রতিশ্রুতি। আমার বাবা যাকে যে প্রতিশ্রুতি দিতেন, সেটা রাখতেন। আমিও বাবার কাছ থেকে এই গুণটা পেয়েছি। চেষ্টা করি কারও কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখার।

অনুলিখিত