কেবল নামেই চলচ্চিত্র নগরী?
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে দেশের প্রথম সরকারি চলচ্চিত্র নগরীর কাজ। শিগগির শুটিং শুরু হচ্ছে না সেখানে। কাজের গতি, পরিকল্পনা ও তৎপরতা বলছে, এ চলচ্চিত্র নগরীকে পুরোপুরি প্রস্তুত করতে আরও অন্তত পাঁচ বছর লেগে যাবে। ৩৭ বছর আগে জায়গা পাওয়ার পর এ বছর শেষ হচ্ছে প্রথম ধাপের কাজ। সেই কাজও হতাশ করেছে পরিচালকদের। অনেকে বলেছেন, এটি হবে কেবল নামেই চলচ্চিত্র নগরী।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০১৫ সালে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটির কাজ। এবার জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হবে প্রথম ধাপের কাজ। এসব কাজ দেখে এবং নকশার পরিকল্পনা জেনে চলচ্চিত্র পরিচালকেরা বলছেন, আধুনিক চলচ্চিত্র নগরীর অনেক সুযোগ-সুবিধাই থাকছে না এখানে। কাজের গতি দেখে অনেকে বলছেন, আগামী পাঁচ বছরেও এর কাজ শেষ হবে কি না সন্দেহ আছে।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার আন্ধারমানিক ও আশুলিয়ার কবিরপুরে নির্মিতব্য এ চলচ্চিত্র নগরীর আয়তন ১০৫ একর। ২০১৫ সালে বরাদ্দকৃত ১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকায় এখানে নির্মিত হয়েছে প্রবেশপথ ও অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের পথ, সীমানাপ্রাচীরের একাংশ, দুটি লেক ও ঘাট, চারতলা ডরমিটরি ভবন, গ্রাম্য বাজার, টিনশেডের ধনী ও গরিবের বাড়ি, আবর্জনার ভাগাড়। কেনা হয়েছে আটটি প্যাডেলবোট, চারটি স্পিডবোট, অধিগ্রহণ করা হয়েছে কিছু কিছু জমি, বসানো হয়েছে একটি বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ও পানির পাম্প। নির্মাণাধীন রয়েছে ডুপ্লেক্স বাড়ি ও রেস্তোরাঁ। তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটির প্রকল্প পরিচালক মো. আজম জানিয়েছেন, প্রথম ধাপের এ কাজের মধ্য দিয়ে ফিল্ম সিটির কাজ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপেই হবে মূল কাজ।
এত দিন এফডিসি, দেশের গ্রামাঞ্চল, থিম পার্ক, ব্যক্তিমালিকানাধীন শুটিংবাড়ি, বিদেশের ফিল্ম সিটিসহ বিভিন্ন লোকেশনে বাংলা সিনেমার দৃশ্যধারণের কাজ করছেন পরিচালকেরা। তাঁদের প্রত্যাশা, ঢাকার চলচ্চিত্র নগরী হবে একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ শুটিং স্পট। সিনেমার দৃশ্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু থাকবে সেখানে। প্রস্তাবিত নকশা ও শেষ হওয়া কাজ দেখে অনেক পরিচালক বলেছেন, আধুনিক ফিল্ম সিটির জন্য প্রয়োজনীয় তেমন সুযোগ-সুবিধা এখানে নেই।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সহসভাপতি মনতাজুর রহমান আকবর বলেছেন, ‘ফিল্ম সিটিতে শহর ও গ্রামে যা কিছু থাকে, তার সবই থাকতে হবে। এখানে সেসব নেই। সংগঠনটির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন বলেন, ‘গ্রাম্য বাজারের নামে দেয়ালবিহীন কয়েকটি ঘর তুলে রাখা হয়েছে। এ রকম বাজার আমি কোনো দিন দেখিনি। ওগুলো না হয়েছে গ্রামের বাজার, না হয়েছে মফস্বলের।’ এ প্রসঙ্গে মো. আজম বলেন, ‘আমরা তো মফস্বল শহরে এ রকম বাজারই দেখেছি। তাঁরা দেখেন না কেন জানি না।’ নামেই ফিল্ম সিটি হচ্ছে—এ রকম মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিচালক সমিতির পরামর্শ নিয়ে কাজ হচ্ছে। পুরোপুরি শেষ না হলে বোঝা যাবে না যে, এটা কেমন হবে। আমাদের আশা, ভালো কিছুই হবে।’
চলচ্চিত্র নগরীর দ্বিতীয় ধাপের কাজের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ৫৭২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। কাজ শুরু করার আগে দেশের বাইরের চলচ্চিত্র নগরী পরিদর্শনে যাবে চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একটি প্রতিনিধিদল। প্রণয়নকৃত নকশায় সংযোজন-বিয়োজনের প্রস্তাব করবে তারা। তাতে বাড়তে পারে প্রকল্পব্যয়। তা ছাড়া চলচ্চিত্র নগরীতে প্রবেশের মূল পথটি এখনো তৈরিই হয়নি। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সীমানাসংলগ্ন বেতারের জায়গার ওপর দিয়ে মূল প্রবেশপথে ঢুকতে হবে।
পরিচালকদের প্রত্যাশা, ভারতের রামোজি ফিল্ম সিটিকে আদর্শ হিসেবে ধরে যতটা পারা যায় বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সিটিকে সেভাবেই নির্মিত হোক। রামোজিতে কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অভিনেতা রোশান বলেন, ‘সিনেমায় দেখাতে হবে এ রকম প্রায় সব ধরনের লোকেশন সেখানে প্রস্তুত, নয়তো তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি করে ফেলা যায়। প্রায় সব মডেলের গাড়ি পাওয়া যাবে। পরিচালকেরা চাইলেই সেসব হাজির। দক্ষ লোকবল, শিল্পী, যন্ত্র সব আছে তাদের।
পরিচালক বদিউল আলম খোকন বলেন, ‘রামোজিতে একটি বিল্ডিং আছে, যেটি চার পাশ থেকে দেখতে চারটি দেশের নির্মাণ কাঠামোর মতো।’ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দৃশ্যমান কেবল কয়েকটি দালান ও বাড়ি। তবে নকশায় রয়েছে আরও বেশ কিছু স্থাপনা। দেখে মনে হবে, চিত্তবিনোদনের সাধারণ পার্ক ও শিশুপার্কের আবহে তৈরি হচ্ছে এ চলচ্চিত্র নগরী।
চলচ্চিত্র নগরীর নকশা ও পরিকল্পনায় রাখা হয়েছে গ্রামীণ ও ঐতিহাসিক স্থাপনা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার উপযোগী স্থাপনা, পাহাড়, ঝরনা, জলপ্রপাত, সুইমিং পুল, হেলিপ্যাড, শিশুপার্ক। এ ছাড়া আর কী কী প্রয়োজন ছিল? এ প্রসঙ্গে খোকন বলেন, ‘জায়গাটি অনেক বড়। রামোজি বা থাইল্যান্ডের বিভিন্ন স্পটগুলো থেকে ধারণা নিয়ে কাজটি করতে পারলে ভালো হতো।’ কর্তৃপক্ষকে এ পরামর্শগুলো দিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে এই পরিচালক বলেন, ‘আমাদের না ডাকলে পরামর্শ দিতে যেতে পারি না। তবু পরিচালক সমিতির পক্ষ থেকে বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
মনতাজুর রহমান আকবর বলেন, ‘একটা গানের জন্য আমাদের অন্তত তিনটি লোকেশন প্রয়োজন। ছবিতে ৫টি গান রাখলে লোকেশন দরকার অন্তত ১৫টি। চলচ্চিত্র নগরীতে সে রকম কিছু নেই, থাকবে কি না জানি না। একটি লেক আছে, সেটা তেমন কাজে আসবে না।’ পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার মত দিয়েছেন, এ জায়গাটিতে অনেক কিছু করার আছে। তবে কাজে আরও আন্তরিকতা প্রয়োজন।’
চলচ্চিত্র নগরীর নকশা করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের প্রতিষ্ঠান ‘প্রকল্প উপদেষ্টা’। নকশা প্রণয়নের পরে কেন বাইরের ফিল্ম সিটি পরিদর্শনে যাওয়া? জানতে চাইলে মো. আজম বলেন, নকশাটিকে আরও সংশোধন পরিমার্জনের সুযোগ রয়েছে। এফডিসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে চলচ্চিত্রবোদ্ধা, পরিচালক ও প্রযোজক সমিতির প্রতিনিধিরা ঘুরে এসে মত দিলে সেটি করতে সুবিধা হবে।
এর পরিকল্পনা প্রসঙ্গে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির হোসেন বলেন, ‘সাবেক এমডি সাহেব সম্ভবত স্টেকহোল্ডারদের নিয়েই মাস্টারপ্ল্যানটি করেছিলেন। সেটার ভিত্তিতেই কাজ এগোচ্ছে। পরে আমিও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মিটিং করেছি। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও পরিচালকদের মত নেওয়া হয়েছে। সেগুলোর সমন্বয়ে কাজ এগিয়ে নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আমরা বসেছিলাম, আরও অনেকের মত নেওয়ার সুযোগ আছে।’
চলচ্চিত্র নগরী সম্পর্কে জানেন না প্রযোজক-পরিচালকদের অনেকেই। দেশের খ্যাতিমান প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান, নাসির উদ্দিন দিলু কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি অর্থ লগ্নিকারী আবদুল আজিজ জানান, ফিল্ম সিটির ব্যাপারে এফডিসি কর্তৃপক্ষ তাঁদের সঙ্গে কোনো আলাপ করেননি। তবে শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর ফিল্ম সিটির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের পরামর্শ নেওয়া হয়নি বটে, তবে উদ্যোগটিকে সাধুবাদ জানাই।’
ফিল্ম সিটির মাস্টারপ্ল্যান করা প্রতিষ্ঠান প্রকল্প উপদেষ্টার পরিচালক ফেরদৌস আহমেদ বলেন, কাজটি প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানে আরও পরিবর্তন করতে হবে। এটার স্কেলটা কী হবে, সেটার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। মন্ত্রণালয় এবং ডিপার্টমেন্ট যেভাবে একে তদারক করছে, মনে হচ্ছে প্রজেক্টের একটা ফান্ড আছে, সেটাকে যেকোনোভাবে শেষ করতে হবে। আমরা চাই একে যথাযথ গুরুত্ব দিতে, যাতে বঙ্গবন্ধুর নামটার গুরুত্ব থাকে।
স্বাধীনতার ৫০তম বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে এফডিসির। পরিচালক নেতারা মনে করছেন, ফিল্ম সিটির নকশা ও নির্মাণে অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রকৌশলীর পাশাপাশি দরকার শিল্পনির্দেশকের সম্পৃক্ততা। চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যয়, সময় ও ঝক্কি কমাতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত একটি চলচ্চিত্র নগরী ঢাকার পরিচালকদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। ১৯৮১ সালে এ জন্য এফডিসিকে ১০৫ একর জায়গা দেয় তথ্য মন্ত্রণালয়।