শতবর্ষে নৃত্যসম্রাজ্ঞী অমলা শঙ্কর

অমলা শঙ্করের সঙ্গে লায়লা হাসান
অমলা শঙ্করের সঙ্গে লায়লা হাসান

যশোরের বাটাজোর গ্রামের সেই ছোট্ট মেয়ে অমর ২৭ জুন শতবর্ষ জন্মজয়ন্তী। কত চড়াই-উতরাই, যোগ-বিয়োগ, পাওয়া-না পাওয়া, সফলতা-ব্যর্থতা, হারানোর ব্যথা, পাওয়ার আনন্দ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মালায় গাঁথা এই শতবর্ষ।

গ্রামের সেই ছোট্ট মেয়ে ‘অম’ অসাম্প্রদায়িক উদার চেতনার বলয়ে বেড়ে উঠেছিলেন বাবার আদর্শে। ১০০ বছর আগে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্মান্ধ সামাজিকতার মধ্যে তাঁরা অভিন্ন চেতনায় উদ্দীপ্ত, বিস্ময় লাগে।

এই মহীয়সী মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ঢাকায় ১৯৮৩ সালে আমার অনুজপ্রতিম নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে। প্রথম দেখাতেই বুকে ছড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন, পরম তৃপ্তিতে মনে হলো আমার অনেক কাছের মানুষটি যেন ঠিক আমার মায়ের মমতামাখা স্পর্শ।

কদিনেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক বেশ পোক্ত হয়ে গেছে। মাসিমা উঠেছিলেন শর্মিলার বউদি—আমাদেরও—পূর্ণিমা বউদির বাড়িতে। বউদি সদাহাস্য মুখে মাসিমার দেখাশোনা, অতিথিদের আপ্যায়ন করে যাচ্ছেন অনবরত।

তখন বিটিভিতে নাচ শেখার অনুষ্ঠান ‘রুমঝুম’ বেশ দর্শকনন্দিত, ঢাকায় আসার পর একদিন বিকেলে অনুষ্ঠানটি (তখন বিকেল চারটায় প্রচারিত হতো) তিনি দেখেছেন। মাসিমার ভালো লাগা আমাকে উদ্বুদ্ধ করে তুলল। ইচ্ছা ছিল, তাঁকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করব, ‘রুমঝুম’-এর বন্ধুদের সঙ্গে এই নৃত্যসম্রাজ্ঞীকে পরিচয় করিয়ে দেব। মাসিমাও সম্মত ছিলেন কিন্তু সে ইচ্ছা আমাদের আর পূরণ হয়নি। কারণটি ঊহ্যই থাকুক।

এরপর আবার মাসিমা এলেন তাঁর ‘উদয়শঙ্কর ব্যালে ড্রপ’ নিয়ে খুব সম্ভব নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে মহামানব নৃত্যনাট্য পরিবেশনার জন্য। মাসিমাও এতে অংশগ্রহণ করেছেন। সময়টা বোধ করি নব্বইয়ের কোনো এক সময়ে। কী অসাধারণ অঙ্গভঙ্গি, মুদ্রা, অভিব্যক্তি—তিনিই মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

অনুষ্ঠান শেষে নৃত্যসম্রাজ্ঞীর নিজ কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘আমার এখন ৮৬ বছর বয়স, আপনাদের ভালোবাসায় আমি আজও নাচের সঙ্গে রয়েছি, নাচ করে যাচ্ছি, আমায় আশীর্বাদ করবেন।’ দর্শকের মুহুর্মুহু করতালিতে প্রেক্ষাগৃহ মুখরিত। মাসিমা আপ্লুত, অভিভূত।

এই আসা-যাওয়ার ফলে আমাদের বাঁধন আরও দৃঢ় হলো। সম্পর্ক আরও নিবিড় হলো। শুধু আমি নই, আমরা দুটি পরিবার পারিবারিক বন্ধু হয়ে গেলাম।

মম, আনন্দ, বাপ্পিদা, তনুশ্রীর কাছে আমরা অতি কাছের লায়লাদি ও হাসানদা (স্বামী সৈয়দ হাসান ইমাম) হয়ে উঠলাম।

আর ওরা হলো আমাদের পরম নিকটজন—অনুজপ্রতিম।

আমাদের সন্তানরা দিদা বলতে অজ্ঞান। মাসিমা এত ভালোবাসেন ওদের।

একবারের একটি ঘটনা দারুণভাবে মনকে নাড়া দেয়। সেটা সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি। মাসিমার বাড়ি গড়িয়াহাটের কাছে প্যান্টালুমের বিপরীতে জয়জয়ন্তীতে আমরা গেছি বেড়াতে। মাসিমা যাচ্ছিলেন রবীন্দ্রসদনে বিএফজের ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড সেরেমোনিতে। আমাকেও নিলেন। বললেন, ‘বাচ্চারা, হাসান ইমাম থাকুন এখানেই। ডিনার করবেন রাতে, আমরা ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যেই ফিরব।’

অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরে দেখি, আমার ছেলে স্বাক্ষরের ভীষণ জ্বর। ১০৬ ডিগ্রি। সবাই আমার অপেক্ষায় ছিলেন, আমি ফিরলেই বাড়ি যাব (মামা মনসুর হাবীবের বাড়ি)। কিন্তু এ অবস্থায় মাসিমা কিছুতেই আমাদের ছাড়লেন না। বললেন, ‘এই অসুস্থ বাচ্চা নিয়ে তোমার কোথাও যেতে হবে না। ওকে নিয়ে এখানেই থাকো।’

মাসিমার আদেশ অমান্য করি কী করে! অগত্যা থেকে গেলাম তাঁর স্নেহের মাতৃছায়ায়। নয় দিন থাকতে হয়েছিল আমাদের, কিছুতেই জ্বর ছাড়ে না, মাসিমা যত বড় বড় চিকিৎসক, শিশুবিশেষজ্ঞ সবাইকে ডেকে পাঠাচ্ছেন। চিকিৎসা চলছে, তবু সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ হচ্ছে না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে ফেরার। যদিও মাসিমা বলছিলেন আরও কটা দিন থাকার জন্য। নয়টা দিন অসুস্থ বাচ্চা নিয়ে তাঁকে কত জ্বালাতনই না পোহাতে হয়েছে। মাসিমা যে কত সেবা-শুশ্রূষা করেছেন স্বাক্ষরের। আমিও অনেক শিখলাম মাসিমার কাছ থেকে: রোগীকে কেমন করে সেবা করতে হয়, কী পথ্য দিতে হয়, বিশেষ করে শরীর স্পঞ্জ করার পদ্ধতিটি—যা আমার একেবারেই অজানা ছিল। একবার ঠান্ডা পানি, একবার গরম পানি দিয়ে বিপরীতভাবে করতে হবে। যেমন ডান হাত মোছালে বাঁ পা মোছাতে হবে, তেমনি ডান পা মোছালে বাঁ হাত মোছাতে হবে। এ সময় আমি মাসিমার কাছে অনেক বকুনি খেয়েছি। আমি ছেলেকে ঠিকমতো দেখাশোনা করছি না, যত্ন নিচ্ছি না, খাওয়াচ্ছি না ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যাঁ খাওয়াটা ঠিকমতো হচ্ছিল না, সেটা ঠিক। ওর পথ্য ছিল বার্লি, ছেলে সেটা কিছুতেই খাবে না, খাচ্ছে না আর দোষের ভাগী হচ্ছি আমি। মাসিমা নিজের ঘরও ছেড়ে দিয়েছিলেন আমাদের জন্য। নন্দিতা, খুড়িদিদা, কাজের মাসি—সবাই অনেক করেছেন আমাদের জন্য। মাসিমার এই ঋণ অপরিশোধ্য। তাঁর কাছ থেকে চলে আসার সময় খুব মন খারাপ করছিলেন।

এক দিনে তাঁকে অনেক কাছ থেকে জানার, দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। তাঁর মায়াভরা সংবেদনশীল হৃদয়, তাঁর ধৈর্য, সহ্য আমাকে মুগ্ধ করেছে।

স্বামী কিংবদন্তী নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সঙ্গে অমলা শঙ্কর
স্বামী কিংবদন্তী নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সঙ্গে অমলা শঙ্কর

মাসিমাকে আরও নিবিড় করে জেনেছি ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যখন আমরা একটানা সাত বছর কলকাতাবাসী হয়েছিলাম। আমাদের ঠিকানা ছিল দিলকুশা স্ট্রিট পার্ক সার্কাস। ওটা আমাদের মামাবাড়ি। প্রায়ই চলে যেতাম তাঁর কাছে, কত দিন যে পাত পেতে বসে গেছি তাঁর সঙ্গে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেছি। অসম্ভব ভালোবাসেন বাংলাদেশকে। বাংলার মানুষকে। এক গভীর টান, যাকে বলে নাড়ির টান, রয়েছে আমাদের দেশটার প্রতি। আমাদের দেশ বলছি কেন, এ যে তাঁরও দেশ—তিনি যে এ বঙ্গেরই কন্যা। তাঁর জন্ম এ দেশে, শৈশব-কৈশোরও কেটেছে যশোরের বাটাজোর গ্রামে। সেই গ্রামে কাটানো শিশুকালের কত গল্পই না করেছেন সুযোগ পেলে। বলতেন, ‘বাংলাদেশের মেয়েরা কী দারুণ সুন্দর দেখতে!’ তাঁর পাশে বসলেই আমার হাত ধরে খেলা করতেন আর নানা গল্প করতেন। ছেলেবেলার গল্প, বিদেশ যাওয়ার গল্প, লেখালেখির গল্প, ছবি আঁকা...মাসিমা চুন, খয়ের দিয়ে কোনো তুলি ব্যবহার না করে আঙুলের নখ দিয়ে কী অসাধারণ ছবি আঁকতেন, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। এভাবে ছবি এঁকে এঁকে তিনি তাঁর নৃত্যগুরু স্বামী উদয়শঙ্করকে কোরিওগ্রাফি করাতে সহায়তা করতেন। মাসিমা আরও গল্প করতেন তাঁর আলমোড়া কালচারাল সেন্টারে নাচ শেখা। যেদিন শ্রী উদয়শঙ্কর তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, ‘আমি ভ্যা করে কেঁদে ফেলেছি।’ মমর (মমতাশঙ্কর) কথা, আনন্দের (আনন্দ শঙ্কর) কথা, জাতি, নাতনিদের কথা, তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় দীক্ষাগুরু, সাঁইজির গল্প—আরও কত কত গল্প! তাঁর ভাইবোন, বাবা-মা, শাশুড়িমা, রবুক (পণ্ডিত রবিশঙ্কর) গল্প—কিছুই বাদ পড়েনি। তাঁর একমাত্র পুত্র আনন্দকে হারানোর ব্যথাভরা অনুভূতি—সবই তাঁর কাছে শুনেছি।

মাসিমা আমাদের দেশের রান্না, বিশেষ করে আমাদের পরিবারের কিছু স্বতন্ত্র রান্না, যা আমার আম্মা ও মার (শাশুড়ির) কাছ থেকে শেখা, খুব পছন্দ করতেন। আমি প্রায়ই দুপুরে বা রাতে এটা-ওটা রান্না করে তাঁর জন্য নিয়ে যেতাম—সরষে-কচু, সরষে-চালকুমড়ার চপ, কচুমুখির সঙ্গে চিংড়ি-তেঁতুলের ঘন্ট, শাপলা-চিংড়ি-নারকেল কোরা দিয়ে ভাজা, মাংসের দমপোক্ত, বিট-মাংস, রোজার দিনে হালিম, ভুনা খিচুড়ি। নার্গিসি কোফতা ইত্যাদি। আমি গেলেই মমকে ফোন করে দিতেন, মম, নন্দিতা, আয়শা (নন্দিতার মেয়ে) সবাই বেশ হইহই করে খাবার উপভোগ করতেন। আমি আমার শ্রম সার্থক হয়েছে জেনে তৃপ্ত হতাম।

২০০৮ সালের এক দুপুরে হঠাৎ মাসিমা নন্দিতাকে (ভাইয়ের মেয়ে) নিয়ে আমাদের (মেজ মামার) দরগা রোডের বাড়িতে চলে এলেন, হাতে চাইনিজ খাবারের অনেকগুলো প্যাকেট। বললেন, ‘চলো আমরা একসঙ্গে খাব।’ আমি যথারীতি খাবার পরিবেশন করলাম। সঙ্গে আমাদের খাবার চিংড়ির দোপেঁয়াজা, সরষে-ইলিশ, চিংড়ি দিয়ে করলা ইত্যাদি। মাসিমার আনা চাইনিজ বাদ—আমার রাঁধা আটপৌরে খাবার আস্বাদন করলেন তিনি।

চিংড়ি-করলাভাজি মাসিমার এই প্রথম দেখা ও খাওয়া, আজও তাঁর প্রশংসাবাক্যগুলো আমার কানে অনুরণিত হয়।

২০০০ সালে মাসিমাকে ঢাকা ক্লাবে বেশ সাড়ম্বরে সংবর্ধনা দেওয়া হলো আমাদের সংগঠন নটরাজের পক্ষ থেকে, সহযোগিতায় ছিল ঢাকা ক্লাব। নটরাজ পরিবেশন করল নৃত্যালেখ্য ‘উৎসারিত আলো’। অনুষ্ঠানটি বেশ উপভোগ্য হয়েছিল। সেবারই বোধ করি তাঁর শেষ আসা ছিল বাংলাদেশে। এরপর আর আসেননি।

যখনই আমি কলকাতা যাই, একবার তাঁকে না দেখলে অতৃপ্তি বোধ হয়। গেলেই উপহারের ডালি তুলে দেন দুহাত ভরে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে গেছি মাসিমাকে দেখতে, কিন্তু মাসিমা বুঝি চিনতে পারলেন না। তাঁর স্নেহের লায়লাকে মিটিমিটি হাসিতে মোহিত করলেন, হাত ধরে বসে রইলেন—মাঝেমধ্যে অস্ফুট দু-একটা কথা উচ্চারণ করছেন কিন্তু তা বোধগম্য হচ্ছে না। শুধু একটিবার একটি শব্দ, শুনতে পেলাম—‘সুন্দর’।

আমার পথপ্রদর্শক (মম ও বাপ্পিদা মানে মমতা শঙ্কর ও চন্দ্রয় ঘোষের বাড়ির পথ কসবায় নিয়ে গিয়েছিলেন যিনি) কনিষ্ঠ বন্ধু মানবী আমাদের ছবি তুলতেই মহাব্যস্ত। এতক্ষণ বাপ্পিদা আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিলেন, এবার নাচের ক্লাস শেষে মম এল। জড়িয়ে ধরে সম্ভাষণ জানাল। হঠাৎ মাসিমার দিকে তাকিয়ে মাসিমাকে দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত মেয়েটিকে ও বলল, ‘এমা, মাকে লালটিপ পরাওনি কেন?’ রোজ বিকেলে সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেলপলিশ লাগিয়ে বসার ঘরে মাসিমাকে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়, যেন একটি জীবন্ত পুতুল নিজেই টুকটুক করে হেঁটে হেঁটে আসেন সাহায্যকারীর সহায়তায়।

এ বছর জানুয়ারি মাসে যখন কলকাতায় সিনেমার শুটিংয়ে গেলেন সৈয়দ হাসান ইমাম, আমিও সঙ্গ নিলাম। বাসনা—মাসিমার সাক্ষাৎ লাভ। বাপ্পিদার সঙ্গে কথাও হলো। সব ঠিকঠাক, কিন্তু শেষমেশ ব্যাটে-বলে মিলল না। পরদিন বাপ্পিদা ছোট ছেলে ও বউমাকে নিয়ে হোটেলে এলেন মমর পাঠানো উপহার নিয়ে।

কথা হলো, ২৭ জুন তাঁর শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে নিশ্চয় উপস্থিত হব। জানি না এ আশাও পূরণ হবে কি না।

মাসিমা, আপনি সুস্থ থাকুন, আরও দীর্ঘদিন আমাদের জড়িয়ে থাকুন—শুভ জন্মদিন।

শুভময় এই শুভদিন আরও শুভময়তা নিয়ে বারবার, বহুবার ফিরে আসবে—এই অফুরান প্রত্যাশায় জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: নৃত্য ও অভিনয়শিল্পী।