তিন প্রজন্মকে নাচ শেখাচ্ছি

কলাবতী দেবী
কলাবতী দেবী
>গুরু বিপিন সিংহের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ২২ ও ২৩ জুন ঢাকায় হয়ে গেল মণিপুরি নৃত্য উৎসব। এতে যোগ দিতে কলকাতা থেকে এসেছিলেন গুরুর স্ত্রী নৃত্যগুরু কলাবতী দেবী। ১২ জুন প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপনে অংশ নেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাসেল মাহ্‌মুদ

মণিপুরিদের ধর্মীয় রীতি থেকে কীভাবে একটা পারফর্মিং আর্টকে বের করে আনা হলো?

রাসলীলা বলে আমাদের একটা অনুষ্ঠান আছে। এর চারটি ভাগ—মহারাস, কুঞ্জরাস, নৃত্যরাস ও বসন্তরাস। এগুলো দল বেঁধে করতে হয়। গুরু অমবি সিংহ সেখান থেকে একটা থিম নিয়ে ছোট্ট পারফরম্যান্স কম্পোজ করেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে মণিপুরি নাচের আজকের অবস্থা। পরে বিপিন সিংহ একে আরও অন্য রকম করে উপস্থাপন করেন।

মণিপুরি নাচের গ্রহণযোগ্যতা কি অন্য শাস্ত্রীয় নাচের মতোই?

এ নাচ অনেক বেশি ধর্মীয় ভাবগম্ভীর। গুরুরা সব সময় শেখাতেন যে নাচ করার সময় একেবারে এদিক-ওদিক তাকাবে না। মনে করবে কৃষ্ণের শ্রীচরণে তাকিয়ে আছ। এটা হচ্ছে ভক্তি। এ জন্য দেখবেন, নৃত্যশিল্পীরা দর্শকদের দিকে না তাকিয়ে নাচ করেন। আজকাল অবশ্য এসব কেউ মানে না। যারা ভীষণ ভক্তিপরায়ণ, শুধু তারাই মানে।

বিপিন সিংহের সঙ্গে আপনার পরিচয় ও পরিণয়ের গল্পটা বলবেন?

আমি আগে গান করতাম। নাচও করতাম। কেননা, রাসলীলায় শুধু দাঁড়িয়ে গান করা যায় না। নাচের সঙ্গেই করতে হয়। বিপিন সিংহ আমার থেকে ২৭ বছরের বড়। পুনেতে একটা নাচের দলের সঙ্গে ছিলেন তিনি। একটা সময় তাদের নাচ আর ভালো লাগছিল না গুরুর। তিনি চলে যান বোম্বেতে। সেখানে নাচ শেখাতে শুরু করেন। সেখানেই তাঁর ছাত্রী হয় জাভেরি সিস্টার্স। জাভেরি পরিবার নমনীয় নাচ পছন্দ করতেন। আমাদের নাচের আঙ্গিকটা ছিল সে রকম। নম্রতা ভাব নিয়ে আমাদের নাচ করতে হয়। সেটা তাঁদের ভালো লেগেছিল বলে পরিবারের চার মেয়ে নয়না জাভেরি, রঞ্জনা জাভেরি, সুবর্ণা জাভেরি ও দর্শনা জাভেরি গুরুর কাছে শিখতে থাকেন। তাঁরাই মণিপুরি নাচকে একটা অবস্থায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করেন। তখন আমি গুরুর কাছে যাই। বোম্বে থেকে ফেরার পর গুরুর আমাকে আর আমার তাঁকে খুব দরকার হয়ে পড়ে। তিনি তখন দুহাতে গান লিখছিলেন। হারমোনিয়ামে কম্পোজ করছিলেন, সুর বসাচ্ছিলেন। তখন সামনে বসে আমি গাইতাম। সে সময় থেকেই তাঁর খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাই। আমাদের একটা মেয়েও আছে, বিম্বাবতী দেবী।

তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে অনুষ্ঠান?

আমি শুধু বলেছিলাম যে কলকাতায় অনুষ্ঠান করছি। লুবনা বলল, ৪০ বছর ধরে আমরা তাঁর নৃত্যধারা চর্চা করে আসছি, এখানে এত ছাত্রছাত্রী। আমরাও তাঁর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন করব। মুখে উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যে সে জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে রাজি হয়ে গেল, এটা আমার খুব ভালো লেগেছে। গত বছরের ২৩ আগস্ট থেকে আমরা অনুষ্ঠান করতে শুরু করেছি। শিবচর ও গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠান হয়েছে। কলকাতায় করেছি।

এ নাচকে যেভাবে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, পেরেছেন সেভাবে?

আমার বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা খুব গুরুত্ব দিয়ে এ নাচ শিখেছে। আমি এদের শিখিয়েছি। এখন এদের ছাত্রছাত্রীদের শেখাচ্ছি। এরা এতই নিবেদিত যে আমার মনে হয় এখানেই থেকে যাই। মনটাকে এরা নাচের ভেতর ডুবিয়ে নাচ করছে। আমার বাড়িতে রেখে ওদের ছাত্রছাত্রীরা শিখছে। বলা যায় তিন প্রজন্মকে নাচ শেখাচ্ছি। এ জন্য ইম্ফাল থেকে বেশি ভালো লাগে আমার এখানে।

পৃথিবীর মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। অসহিষ্ণুতার ফলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আপনাদের কষ্ট দেয় না?

সবাইকেই কষ্ট দেয়। এ ধরনের ঘটনা কলকাতায় ঘটে, ইম্ফালে ঘটে। রাসলীলার ওপর কখনো কখনো হামলা হয়। কেননা, আমাদের নিজস্ব আরেকটা ধর্ম আছে। ওই ধর্ম না নিয়ে কেন বৈষ্ণব ধর্ম নিয়ে রাসলীলা-টাসলীলা এসব করি, এ নিয়ে তাঁদের আক্ষেপ। আমাদের ওখানেও জঙ্গি আছে। আগে আমাদের আদি ধর্ম ছিল। কিন্তু আমরা বৈষ্ণব। ওদের কথা হচ্ছে, কেন বাইরে থেকে বৈষ্ণব এসে এসব করছে? সেখানে একটা আন্দোলন শুরু হয়েছে যে বৈষ্ণব ধর্মের কারণে আমাদের আদি ধর্মটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা ওটাকেই আঁকড়ে ধরব। বৈষ্ণব ধর্মের আচার-আচরণ চর্চা করা যাবে না। এটা তরুণদের মধ্যেই বেশি দেখা যাচ্ছে। রাসলীলা এখন অনেক কমে গেছে। আয়োজন করতে হয় ভয়ে ভয়ে। আগে তো কারও ঘরে পুত্রসন্তান জন্ম নিলেই কৃষ্ণ বানিয়ে লীলা করত। অনেক খরচ তাতে, অনেকে সেই খরচ করে।

ভক্তিমূলক নমনীয় এ নাচের প্রসারে তাঁর অবদান শিল্পাঙ্গনে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন কীভাবে?

আমার ছাত্রীরা—তামান্না, প্রেমা, ওয়ার্দা, সুইটি এবং তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা নাচ করছে। আমার মেয়ে বিম্বাবতী যেভাবে নাচ করছে, এভাবেই গুরু বিপিন সিংহ ছড়িয়ে যাচ্ছেন। বহু লোক এ নাচ করছে। এ দেশের মণিপুরিদেরও নাচটি শেখানো হচ্ছে।