দেশ নাটক-এর ৩২-এ পা

দেশ নাটকের অন্যতম প্রযোজনা িনত্যপুরাণ
দেশ নাটকের অন্যতম প্রযোজনা িনত্যপুরাণ

পয়লা জুলাই ছিল ঢাকার অন্যতম নাট্যদল ‘দেশ নাটক’-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ বছর বত্রিশে পা রাখল দেশ নাটক। এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে দেশ নাটক পালন করল তাদের জন্মতিথি। দলের নতুন-পুরোনো মিলিয়ে প্রায় এক শ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। সবাই মিলে গাইলাম, স্মৃতিচারণা করলাম আর সম্মাননা জানালাম দলীয় নাট্যকারদের। দেশ নাটক-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রসঙ্গ ধরে মঞ্চনাটক নিয়ে দু-একটা কথা বলি; মঞ্চনাটক তার জৌলুশ হারিয়েছে, এ রকমটা ভেবে নেওয়া হচ্ছিল কিছুদিন আগ পর্যন্ত। তবে অবস্থা পাল্টাতে শুরু করেছে। দর্শক এখন কিছুটা হলেও মঞ্চমুখী হচ্ছেন। মঞ্চ যেন জেগে উঠছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে এক উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি গ্রুপ থিয়েটার চর্চা। স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন নতুন নাটকের দল তৈরি হলো। বার্ষিক বা দিবসনির্ভর নাটকের পরিবর্তে এল নাটকের নিয়মিত প্রদর্শনী। দর্শকেরা দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখতে শুরু করলেন। জমে উঠল বেইলি রোডের মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস মঞ্চ। থিয়েটারের প্রাণকেন্দ্র হয়ে গেল এই দুটি মঞ্চ, যার প্রভাবে বেইলি রোডের নাম পরিবর্তিত হয়ে নাটক সরণি হলো। কেবল পত্রিকার একটা বিজ্ঞাপন ছিল প্রচারের মাধ্যম। সেই বিজ্ঞাপন দেখে এমনকি ঢাকার বাইরে থেকেও দর্শক আসতেন নাটক দেখতে। আরণ্যক, নাগরিক, থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, নাট্যচক্রসহ আরও অনেক থিয়েটার গ্রুপ গড়ে উঠল ঢাকাতে। আশির দশকের গোড়ার দিকে আমাদের ওপর চেপে বসা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নিমিত্তে গঠিত হলো—বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। মঞ্চ তখন এক সফল মাধ্যম। এই মঞ্চ থেকেই টিভি নাটকের জন্য ডাক পড়ত অভিনয়শিল্পীদের। এরপর নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে মঞ্চনাটকের চর্চা। নগরের যানজট, নাগরিক ব্যস্ততা এসব কারণে দর্শকের ঘাটতি দেখা দিল নাটকের প্রদর্শনীগুলোতে। তবু থেমে যায়নি নাটকের দলের কাজ, বন্ধ হয়নি নাটকের প্রদর্শনী। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশ নাটকও এই চর্চায় ব্রত আছে। শামসুল আলম বকুল, ইশরাত নিশাত, সালাহউদ্দিন লাভলু, তপন দাশ, শিরিন খান মনি, এনায়েত লিপনসহ আরও কিছু নাটকপাগল কর্মীর সমন্বয়ে ১৯৮৭ সালে জুলাই মাসে দেশ নাটক প্রতিষ্ঠা পায়। তখন স্বৈরশাসনের কাল। তপন দাশের লেখা মহারাজার গুণকেত্তন নাটকের মঞ্চায়নের ভেতর দিয়ে শুরু হলো তাদের নাট্যযাত্রা। শুরুতেই তাদের এ যাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়াল সামরিক জান্তা। নাটকটি পথের নাটক ছিল। প্রথম মঞ্চায়নের সময় এই নাটক বন্ধ করে দিল তারা। কেড়ে নিল নাটকে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রের সব উপকরণ। প্রহৃত হলেন নাটকে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা। তবু দেশ নাটক থেমে থাকেনি। শত বাধার মুখেও নাটকটির প্রদর্শনী বন্ধ করেনি দেশ নাটক। সামরিক শাসনবিরোধী আরেকটি নাটক খেলা ছিল দলের দ্বিতীয় নাটক। এটিরও লেখক তপন দাশ, নির্দেশক শামসুল আলম বকুল। যাত্রা নাস্তি দলের তৃতীয় নাটক। লিখেছেন দলের বর্তমান প্রধান ইশরাত নিশাত। গত তিন দশকে দেশ নাটক মঞ্চে এনেছেন মোট বাইশটি নাটক। যার মধ্যে দুটি ছাড়া সবগুলোই দলের নিজস্ব নাট্যকারের লেখা। দলের নাট্যকার হিসেবে অন্যদের মধ্যে রয়েছেন হাফিজ রেদু, নাসিরউদ্দিন শেখ, শিহাব শাহিন, মাহবুব লিলেন। সব মিলিয়ে সহস্র রজনীর অধিক প্রদর্শনী করেছে দলটি। দলের সর্বশেষ নাটক আমার লেখা সুরগাঁও। এটি একটি নাট্যকার নির্দেশিত নাটক। নাট্যকার নিজেই যেহেতু এই নাটকের নির্দেশক, তাই আমরা আমাদের প্রচারণায় ‘একটি নাট্যকার নির্দেশিত নাটক’ এই কথাটা ব্যবহার করেছি। আমার লেখা নিত্যপুরাণ এর বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। নিত্যপুরাণ প্রথম মঞ্চে এসেছিল ২০০০ সালে। এ বছর নতুন করে এটি আবার মঞ্চে এনেছি আমরা। সুরগাঁও এর সঙ্গে এই নাটকটিরও নিয়মিত প্রদর্শনী চলছে শিল্পকলা ও মহিলা সমিতি মঞ্চে। দুটি সফল নাট্য উৎসবেরও অভিজ্ঞতা আছে এই দলের। দলের অনেক কর্মীই এখন টিভি মিডিয়ার পরিচিত নাম। বন্যা মির্জা, নাজনিন হাসান চুমকি, আনিসুর রহমান মিলন, আদনান ফারুক হিল্লোল, শোয়েব আহমেদ, গিয়াস উদ্দিন সেলিম, শিহাব শাহিন, অয়ন চৌধুরী, সুষমা সরকার, আশরাফুল আশীষ, দীপান্বিতা মার্টিন তাঁদের ভেতর উল্লেখযোগ্য। দেশ নাটক মনে করে, মঞ্চে নাটক দেখতে এসে গোটা শহরটাকে সংস্কৃতবান করে তোলা দর্শক হিসেবে আপনার নাগরিক দায়িত্ব। যানজটের বা সময়ের অজুহাতে আপনি যদি শিল্পচর্চাকে পৃষ্ঠপোষকতা না দেন, তবে আপনার শহরকে প্রকৃত শহর বলা যাবে না। নাটক তৈরির দায় আমাদের, কিন্তু সেই নাটক দেখতে এসে শিল্প সেবার দায়িত্ব আপনাদের।

লেখক: নাট্যকার।