সেন্সর বোর্ডের কী খবর

রাজধানীর রমনা এলাকার ইস্কাটন গার্ডেন রোডের সুবিশাল রেড ক্রিসেন্ট বোরাক টাওয়ার। যার ৯ তলায় একটি ভাড়াবাড়িতে এখন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের কার্যালয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দুনিয়া জানে এই কার্যালয়ের মাহাত্ম্য। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের খবর নিতে গিয়েছিলেন মাসুম অপু

এমনিতে বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের অবস্থা ভালো না। তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই যেন চলছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড। সংস্থার সমস্যা অনেক। নিজস্ব ভবন নেই। বছরের পর বছর ভাড়াবাড়িতে চলছে এর কার্যক্রম। ছবি দেখার আধুনিক ব্যবস্থা নেই, বিদেশি ছবিগুলো বাইরে দেখতে হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ মাস হতে চলল, এখনো আগের কমিটিই চালাচ্ছে বোর্ড। কমিটির সভায় বেশ কয়েকজন সদস্য দিনের পর দিন অনুপস্থিত। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের নাম বদলের পাশাপাশি নীতিমালায়ও বেশ কিছু পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এর খসড়া তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড তথ্য মন্ত্রণালয়াধীন একটি প্রতিষ্ঠান। সংস্থাটি জনসাধারণের মধ্যে প্রদর্শিত হবে—এমন সব চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপনচিত্র ইত্যাদি পরীক্ষা করে সেন্সর সনদ দেয়। বিগত পাঁচ বছরে গড়ে ৭৫টি ছবির অনুমোদন দিয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা রাজস্ব আয় করেছে। প্রতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের ধারাবাহিকতা থাকছে।

৪৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বোর্ড। অথচ এখনো সংস্থাটির নিজস্ব কোনো ভবন নেই। অবশ্য খুব শিগগির এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে জানালেন সেন্সর বোর্ডের সচিব মোহাম্মদ আলী সরকার। তিনি বলেন, সার্কিট হাউস রোডে নির্মাণাধীন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর ভবনে সেন্সর বোর্ডের নিজস্ব কার্যালয় এবং প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকবে। ভবন নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। সেখানকার ১৬ তলায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য হল তৈরি হবে। কাজ দ্রুত এগোলে আগামী ডিসেম্বরে নতুন ভবনে যেতে পারবে সেন্সর বোর্ড।

কমিটির ২২ মাসে বছর!

সেন্সর বোর্ডে নির্মাতাদের চলচ্চিত্র দেখে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এক বছর পরপর গঠিত হয় নতুন কমিটি। সেই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এক বছরের জন্য বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়। সে সময় তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানকে সদস্যসচিব করে তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব, আইন ও বিচার বিভাগের একজন প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়ে গঠিত হয় কমিটি। কমিটিতে আরও আছেন সংগীতশিল্পী আবদুল জব্বার, অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদ, মঞ্চব্যক্তিত্ব রোকেয়া রফিক বেবী, সাংবাদিক শাবান মাহমুদ। আছেন বাংলাদেশ বেতারের সাবেক উপমহাপরিচালক জাহিদুল হক, পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার, প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ, চলচ্চিত্র প্রযোজক নাসিরউদ্দিন দিলু।

এর মধ্যে শিল্পী আবদুল জব্বার ২০১৭ সালের আগস্টে মারা গেছেন। শুরু থেকেই অনুপস্থিত অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদ। বেশির ভাগ প্রদর্শনীতে সাংবাদিক শাবান মাহমুদও সময় দিতে পারেন না।

গত সেপ্টেম্বরে এক বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এই কমিটির। স্বাভাবিক নিয়মে নতুন কমিটির আসার কথা। তবে এখনো পুরোনো ব্যক্তিরাই চালাচ্ছেন। বর্তমান কমিটির অন্তত তিনজন সদস্য বলছেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের লিখিত কোনো চিঠিতে কমিটির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটেও এ-সংক্রান্ত কোনো নোটিশ পাওয়া যায়নি।

চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ একসময় সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি এর আগে এমনটা দেখেননি। বললেন, ‘এবারই এর ব্যতিক্রম দেখছি। এটা উচিত না।’

পরীক্ষার্থীর বাড়িতেই পরীক্ষাকেন্দ্র!

দেশে এখন নতুন ছবির সংখ্যা কমে গেছে। বিদেশি ছবিগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয় প্রেক্ষাগৃহগুলোকে। বিশেষ করে মধুমিতা, স্টার সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার সিনেমাসে চলছে হলিউড বা বিদেশ থেকে আমদানি করা ছবিগুলো। এই ছবিগুলোরও সেন্সর সনদ লাগে। কিন্তু এই ভিন্ন ফরম্যাটের (ডিসিপি) ছবিগুলো দেখার কোনো ব্যবস্থা সেন্সর বোর্ডে নেই।

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হলে গিয়ে ছবিগুলো দেখতে হয়। এর মধ্যে শো মোশন লিমিটেডের আমদানি করা ছবিগুলো বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে দেখানো হয়। আর ব্লকবাস্টার সিনেমাসের আমদানি করা ছবিগুলো যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেমাসের প্রেক্ষাগৃহে দেখা হয়।

বিষয়টিকে পরীক্ষার্থীর বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার সঙ্গেই তুলনা করলেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট অনেকে। এ প্রসঙ্গে সেন্সর বোর্ডের সদস্য ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বলেন, তাঁর খুব বিব্রত লাগে অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছবি দেখতে। তা ছাড়া যমুনা ফিউচার পার্ক সেন্সর বোর্ড কার্যালয় থেকে বেশ খানিকটা দূরে। এ জন্য অনেক সদস্য যেতে চান না। সপ্তাহে এক দিন, মঙ্গলবারে সিনেপ্লেক্সে ছবি সেন্সরের আয়োজন করা হয়। যেসব আমদানিকারকের নিজস্ব প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেই, তাদের জন্য ৩০ হাজার টাকায় ভাড়া করতে হয় সিনেপ্লেক্স। এমনিতে সেন্সরের জন্য আবেদন করলে ছবির আয়তন হিসেবে নির্দিষ্ট ফি জমা দিতে হয়। বাড়তি হল ভাড়া গুনতে আমদানিকারক-পরিবেশকেরা নারাজ। বোর্ডে ছবি দেখার ব্যবস্থা থাকলে এই টাকা দিতে হতো না।

বিদেশি ছবি দেখতে ডিজিটাল সিনেমা প্যাকেজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই দরপত্র করতে পারেনি সংস্থাটি। অবশ্য আশার আলো দেখালেন প্রতিষ্ঠানটির সচিব মোহাম্মদ আলী সরকার। জানালেন, ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার বাজেট হয়েছে। খুব শিগগির দুটি ডিজিটাল সিনেমা প্যাকেজ চালু করবে সেন্সর বোর্ড।

সেন্সর শব্দটিই চলচ্চিত্রকারদের জন্য অসম্মানজনক। একজন চলচ্চিত্রকার সম্মানিত ব্যক্তি, তিনি অবশ্যই নিয়মকানুন মেনে কাজ করেন। তাঁর কাজ নিয়ন্ত্রণ কেন করা হবে? বরং নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে।
আমজাদ হোসেন

বদলে যাবে সেন্সর বোর্ড?

সেন্সর বোর্ডের নাম বদলের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছিলেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা আমজাদ হোসেন প্রশ্ন করেন, ‘একটি স্বাধীন দেশে সেন্সর বোর্ড কেন থাকবে?’ তিনি বলেন, ‘সেন্সর শব্দটিই চলচ্চিত্রকারদের জন্য অসম্মানজনক। একজন চলচ্চিত্রকার সম্মানিত ব্যক্তি, তিনি অবশ্যই নিয়মকানুন মেনে কাজ করেন। তাঁর কাজ নিয়ন্ত্রণ কেন করা হবে? বরং নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে।’ ভারতের আদলে ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ড রাখার প্রস্তাব করছেন নির্মাতা-প্রযোজকেরা।

অভিনেতা, পরিচালক, গীতিকার আমজাদ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

চলচ্চিত্রকারদের এমন দাবির যৌক্তিকতা আমলে নিয়ে বোর্ডের নাম ও নীতিমালা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নতুন আইনের খসড়াও হয়েছে। প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন’–এ চলচ্চিত্রের গ্রেডিং পদ্ধতিও চালু করার প্রস্তাব আছে। যেখানে বয়সভেদে ৭ বছরের নিচে, ১২ বছরের নিচে, ১৮ বছরের ওপরেসহ মোট পাঁচটি শ্রেণিবিন্যাস ও মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন নীতিমালায় কিছু ক্ষেত্রে কড়াকড়িও আরোপ করা হচ্ছে। যেমন ট্রেলার প্রকাশের জন্যও অনুমোদন লাগবে। অনুমোদন ছাড়া সিনেমা হল, ইউটিউব বা অন্য কোথাও ট্রেলার দেখানো যাবে না।

তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, খসড়া আইনটি এখন মন্ত্রণালয়ে। নতুন আইন পাসের পর কাজ শুরু করবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড

নামকরণ

চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ আইনের অধীনে ১৯৬৩ সালে ‘সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সেন্সরস’ নামে এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র বোর্ড’ করা হয় এবং একই সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ অধিদপ্তরের মর্যাদা দেওয়া হয়। ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড’ সংশোধিত ১৯৬৩ সালের চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ আইন এবং ১৯৭৭ সালের চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ বিধি অনুসারে পরিচালিত হয়ে আসছে।

পদ্ধতি

সেন্সর বোর্ড দেশে নির্মিত এবং বিদেশ থেকে আমদানি-করা চলচ্চিত্র প্রদর্শনযোগ্যতা সাপেক্ষে সনদপত্র দেয়। বিদেশি দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন উত্সবে যেসব চলচ্চিত্র দেখানো হয় এবং বিকল্প ধারা হিসেবে দেশে যেসব স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়, সেগুলোর প্রদর্শনযোগ্যতা যাচাইও সেন্সর বোর্ডের কাজ। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ৩ জুলাই বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে ইনক্রেডেবলস টু ছবিটি দেখেন বোর্ডের সদস্যরা।

অনুমোদন

চলচ্চিত্রের নির্মাণকাজ শেষে মুক্তির অনুমতির জন্য সেন্সর বোর্ডে প্রদর্শন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী অনুমোদিত সিনেমাগুলো আপিল বোর্ডের মাধ্যমে পুনরায় প্রদর্শন করার সুযোগ থাকে। সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন বিবেচনার জন্য সরকার কর্তৃক গঠিত ৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি ফিল্ম সেন্সর আপিল কমিটি রয়েছে। আপিল কমিটির সিদ্ধান্তে চলচ্চিত্রটি বিনা কর্তনে বা কর্তন/সংশোধন সাপেক্ষে প্রদর্শন উপযোগী বিবেচিত হলে সেন্সর সনদপত্র দেওয়া হয়। বিগত বছর আলোচিত ডুব ছবি নিয়ে এমন জটিলতা তৈরি হয়েছিল। পরে ছবিটিকে সেন্সর অনুমোদন দেওয়া হয়।

চলচ্চিত্রের অশ্লীলতা

চলচ্চিত্রের অশ্লীলতা, নকল প্রবণতা ও দৈন্যদশা দূর করার জন্য বোর্ড বিদ্যমান সংশ্লিষ্ট আইনকানুন প্রয়োগ করা এ প্রতিষ্ঠানের কাজ। প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, অশ্লীল ও অবৈধ চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধের জন্য বোর্ডের সদস্য, কর্মকর্তা এবং চলচ্চিত্র পরিদর্শকেরা দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত সিনেমা হল পরিদর্শন করেন। সেন্সর আইন অমান্য করে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হলে এবং চলচ্চিত্রের প্রচারকার্যে কোনো প্রকার বেআইনি কর্মকাণ্ড দেখা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়।

সিনেমা হলের অবস্থা

চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড শুধু ছবির ছাড়পত্র দেওয়া বা বাতিল করেই ক্ষান্ত হয় না, সিনেমা হলের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। অনেক সময় মালিকেরা সেন্সর করা ছবিতে আপত্তিকর দৃশ্য সংযোজন করে হলে প্রদর্শন করেন।

চলচ্চিত্র সংসদ

চলচ্চিত্র সংসদ (ফিল্ম ক্লাব) নিবন্ধন দেওয়া কাজটি সেন্সর বোর্ড করে থাকে। চলচ্চিত্র সংসদ/ফিল্ম ক্লাব/সোসাইটির নিবন্ধন/নবায়নের জন্য বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়।