'লোকগানের ধারাকে দুর্বল করতে পারেনি অন্য কোনো ধারা'

জাতীয় নাট্যশালার মহড়াকক্ষে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ‘সমকালীন গান, প্রগতি প্রত্যাশা’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দেন সায়ান। ছবি: প্রথম আলো
জাতীয় নাট্যশালার মহড়াকক্ষে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ‘সমকালীন গান, প্রগতি প্রত্যাশা’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দেন সায়ান। ছবি: প্রথম আলো

সমকালীন বাংলা গানে একদিকে যেমন সমাজসচেতনতা যোগ হয়েছে, অন্যদিকে সমাজের কূপমণ্ডূকতা, অন্ধবিশ্বাসের পুনরাবর্তন, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, সুবিধাবাদ, হতাশা, ভাগ্যনির্ভরতা সমকালীন গানকেও কলুষিত করছে।

গতকাল শনিবার উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ‘সমকালীন গান, প্রগতি প্রত্যাশা’ শীর্ষক সেমিনারে এমন মন্তব্য করেন বক্তারা। এ সময় বক্তারা প্রত্যাশা করেন, সমকালীন গান হবে গণমুখী, জীবনমুখী, আরও লড়াকু এবং প্রগতিমুখী—যা মানুষকে সচেতন করবে, কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে বিজ্ঞানমনস্ক করবে, স্বাধীনতার বোধ জাগ্রত করবে, সহিষ্ণুতা ও অসাম্প্রদায়িকতা শেখাবে। মানবিক করবে, নারী-পুরুষ বৈষম্য থেকে শুরু করে সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে শেখাবে, সব মানুষের প্রতি ভালোবাসা শেখাবে আর শেখাবে অধিকার অর্জনের জন্য লড়াই করতে।

উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা ভবনের মহড়া কক্ষে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গণসংগীতশিল্পী শুভ প্রসাদ নন্দী মজুমদার, উদীচীর সহসভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান, গণসংগীতশিল্পী কফিল আহমেদ, সায়ান, জলের গানের প্রধান রাহুল আনন্দ, শিল্পী শাবাব আলী আরজু, বাংলা একাডেমির উপপরিচালক তপন বাগচী এবং উদীচী কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নাজমুল আজাদ। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উদীচীর সহসভাপতি গণসংগীতশিল্পী মাহমুদ সেলিম। সভাপতিত্ব করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক সফিউদ্দিন আহমদ।

সমকালীন বাংলা গান বলতে সমকালে প্রবহমান সব ধারাকেই ধরতে হবে মন্তব্য করে মূল প্রবন্ধে উদীচীর সহসভাপতি মাহমুদ সেলিম বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আর একটি ধারা বাংলা সংগীত জগতে প্রাবল্য লাভ করে। সেটি হচ্ছে পাশ্চাত্য প্রভাবিত ধারা। একে কেউ পপসংগীত, কেউ ব্যান্ড সংগীত ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেন। একদিকে নতুন কিছু করার উদগ্র বাসনা, অন্যদিকে স্বাধীনতার পর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধানজনিত হতাশা এবং পাশাপাশি সেই হতাশাকে পুঁজি করে একশ্রেণির মানুষের তরুণ সমাজকে বিভ্রান্তও নেশাগ্রস্ত করার সচেতন অপপ্রয়াস—এমনি জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে পপ সংগীতের এই ধারার সূচনা। মুক্তিযোদ্ধা আজম খান, ফিরোজ সাঁই, লাকী আখান্দ্ প্রমুখ শিল্পীর হাত ধরে শুরু হওয়া এ ধারা প্রথমে ছিল চিত্কৃত এবং দুর্বল বাণী আশ্রয়ী। কিন্তু এর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশস্পর্শী।’

তিনি আরও বলেন, বাংলা গানের আরেকটি ধারা হচ্ছে লোকগানের ধারা, যা অত্যন্ত শক্তিশালী। কোনো নতুন ধারার আগমনই একে দুর্বল করতে পারেনি। বরং নতুন ধারার অভিঘাতে চিরায়ত লোক ধারা বারবার পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।

সময়ের ছায়া শিল্পীর গানে পড়তে বাধ্য বলে মন্তব্য করেন কফিল আহমেদ। তিনি বলেন, জনপ্রিয়তাই উত্তম গায়ক হওয়ার প্রমাণ নয়।

একসময় গানে জীবনের প্রতিফলন থাকলেও বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই তা পরিলক্ষিত হয় না। এমন মন্তব্য করে সংগীতশিল্পী সায়ান। তিনি সমকালীন গানে এ যুগের মানুষের জীবনসংগ্রামকে তুলে ধরার আহ্বান জানান।

সেমিনারে বর্তমান সময়ের গানে বাণীর দুর্বলতা আর সুরের দুরবস্থা প্রকট আকার ধারণ করেছে মন্তব্য করেন তপন বাগচী। তাঁর মতে, বেশির ভাগ গানে প্রগতির কথা নেই, অথবা যাঁরা প্রগতির কথা ভাবেন, তাঁরা গান থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন।