যে কারণে ১৬ বছর পর নিসার হোসেনের প্রদর্শনী

অধ্যাপক নিসার হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
অধ্যাপক নিসার হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

শিল্পী অধ্যাপক নিসার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন। রাজধানীর কলাকেন্দ্রে চলছে তাঁর একক প্রদর্শনী ‘বিকারগ্রস্ত সময়ের রৈখিক বয়ান’। চলবে ২০ জুলাই পর্যন্ত। এর আগে তাঁর ছবি নিয়ে শেষ প্রদর্শনী হয়েছিল ২০০১ সালে। এই দীর্ঘ বিরতির পর প্রদর্শনী নিয়ে ৩০ জুন প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বললেন।

১৬ বছর! এতকাল পর প্রদর্শনী কেন?
রেগুলার ছবি আঁকলেও আমি রেগুলার প্রদর্শনী করার লোক না। প্রদর্শনীটা করব কেন? দুটো কারণে করতে পারি। এক. ছবি বিক্রির জন্য, দুই. ছবি প্রদর্শনের জন্য। আমি যে ছবিগুলো আঁকি, সেগুলো খুব একটা দৃষ্টিনন্দন নয়। মানুষ যখন ছবি দেখে বা ঘরে টাঙায়, তখন সে চায় এমন একটা কিছু, যা তার জন্য দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু আমার ছবিগুলোর বিষয়বস্তু পীড়াদায়ক। সেসব দেখার জন্য আমি লোককে ডেকে এনে পীড়া দিতে পারি না। এখন প্রদর্শনী করছি, কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে, এই সময়ে মানুষকে এ ছবিগুলো দেখানো দরকার বা তাদের কথাগুলো বলা দরকার। ২০০১ সালে প্রদর্শনী করেছিলাম, যখন জোট সরকার এসে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের ওপরে অত্যাচার শুরু করল, খুন শুরু করল। আমি কিন্তু সেই ছবিগুলো এঁকেছিলাম ১৭ বছর ধরে। মনে হলো, এখনই সময়। এটা একধরনের প্রটেস্ট বা এই রিয়্যালিটির একধরনের ডকুমেন্টেশন।

‘বিকারগ্রস্ত সময়’ বলতে কোন সময়কে বুঝিয়েছেন?
আমার কাছে মনে হয়েছে, যে ছবিগুলো আঁকছি, সবই কেন যেন একটা অ্যাবনরমাল সিচুয়েশনের প্রতিফলন। যা কিছু দেখছি, সেগুলো আন-এক্সপেকটেড, যেগুলো সুস্থ পরিবেশের মধ্যে হয় না। দেখেন, নিউজ বলতে আমরা কী বুঝি? হয়তো কেউ অ্যাকসিডেন্ট করল, মারা না যাওয়া পর্যন্ত নিউজ হয় না। কিংবা মা তাঁর সন্তানদের মেরে ডেডবডি লুকিয়ে রাখছে, পিতা তার প্রতিবেশীকে ফাঁসানোর জন্য নিজের মেয়েকে কেটে রেখে দিচ্ছে। এই যে চারদিকে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, পত্রিকা খুললেই যেগুলো দেখি, তাতে মনে হয়, আমরা সামাজিকভাবে এবং সবদিক থেকে এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা অস্বাভাবিক। সহকর্মীদের মধ্যে যেকোনো কিছু নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া দেখছি, যেসমস্ত কথা শুনছি, সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিকতা, মূল্যবোধগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিকতার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। এ জন্যই মনে হচ্ছে, আঁকার জন্য যে দাগ দিচ্ছি, কনটিনিউয়াসলি যে ভঙ্গিগুলো আসছে, সেগুলোর মধ্যে আমার এক্সপেকটেশনের একধরনের হতাশাও আছে। এগুলো থেকে সুন্দর একটা ভঙ্গি বের হচ্ছে না, সুন্দর একটা এক্সপ্রেশন বের হচ্ছে না। সবই বের হচ্ছে কুৎসিত, কদাকার, হিংস্র, ঘৃণাযুক্ত এক্সপ্রেশন। পত্রিকা পড়ে, চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে, অবচেতনে একধরনের বিকার। ঢাকার রাস্তায় বের হলে কী মনে হয়? কোনো মানুষই কোনো অর্ডারের মধ্য দিয়ে চলছে না। শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। যেকোনো মানুষ যা খুশি তা-ই করছে। এগুলোর মধ্য দিয়ে মনে হচ্ছে, একটা অস্বাভাবিকতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। মানুষ যেন বিকারগ্রস্ত।

তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় ২০০৭-১৮ সময়টিই বিকারগ্রস্ত?
আসলে এখানে যে ছবিগুলো আছে, সেগুলোর অনেক ছবি ২০০৭ সাল থেকে আঁকছি। এ যে পুরো সময়টা ধরে যে কাজগুলো করলাম, সেগুলোকে একটা কমন টাইটেলে আনতে হবে। প্রদর্শনীর জন্য বেছে নিয়েছি লাইনপ্রধান ছবিগুলো। সেই কারণেই নাম দিয়েছি ‘রৈখিক বয়ান’। যে রেখা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা তালপাতায় এসে শেষ হয়েছে। প্রদর্শনীর ছবিগুলোর একটা অংশ প্রিন্টের, যেটাকে বলে ছাপচিত্র। আর যেটা সরাসরি, সেটা তালপাতার ওপরে আঁকা, সেটার একটা ট্রেডিশন ছিল, এখনো আছে উড়িষ্যাতে।

জয়নুলের ছবির মতো বহু বছর পর এই ছবিগুলো এখনকার সময়কে ধারণ করে থাকবে?
আমি সব সময় বর্তমান নিয়ে চিন্তা করি। এই মুহূর্তে যারা ছবি দেখছে, তারা কী ভাবছে, তারা কীভাবে রি-অ্যাক্ট করছে, সেইটুকুই আমি দেখি। ভবিষ্যতে কী হবে না হবে, সেটা আমার দেখার দরকার নেই। আমরা যে চলছি-ফিরছি, সেসব যদি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে করি, আসলে সেটা চিন্তা করা যায় না কিন্তু। অনেকেই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেক কিছু করেছেন, সেটা ভবিষ্যৎ পর্যন্ত টেকেনি। আর জয়নুল যে কাজটি করেছিলেন, সেগুলো কিন্তু সাধারণ কাগজে এঁকেছিলেন। দেখলে বোঝা যায়, তিনি একবছর পরের কথাও চিন্তা করেননি। কিন্তু তাঁর সেই ছবির সমকালীনতা, সামাজিক প্রেক্ষাপটে তার উপযোগিতা এবং আজ পর্যন্ত বিষয়গত, নান্দনিক ও প্রকাশগত দিক থেকে তার গুরুত্ব রয়ে গেছে বলেই আমরা এখনো মূল্য দিচ্ছি। এ ছাড়া ছবিগুলোর একটা ঐতিহাসিক ও আর্কাইভাল মূল্য আছে। সেটা অবশ্য ভিন্ন মূল্য। বর্তমান সময়ের আর্টের যে মূল্য আছে, সেই দিক থেকেও ছবিগুলো মূল্যবান। অনেক ছবি আছে, যেগুলোর এখন আর কোনো মূল্য নেই, যেমন ‘মোনালিসা’। এখনকার ল্যাঙ্গুয়েজের কাছে সেটার তেমন কোনো মূল্য নেই। কিন্তু জয়নুলের ছবি আমাদের কাছে মূল্যবান। এগুলো নির্ভর করে। যেমন তালপাতার ওপর যে কাজ হতো, সেটা সেই সময়ে শেষ হয়ে যায়। আমাদের এখানে তো প্রজ্ঞা পারমিতার মতো কেউ কনটিনিউ করেনি। পুথি হিসেবে কনটিনিউ করলেও আর্ট হিসেবে করেনি। আমি এখন করলাম আর্টওয়ার্ক হিসেবে, সবচেয়ে বেশি অ্যাপ্রিসিয়েশন পাচ্ছি। কিন্তু মিডিয়াটা যারা করে গেছে, তারা ভাবেননি যে আজ থেকে দেড় হাজার বছর পরে একজন আর্টিস্ট আমাদের এই মিডিয়া নিয়ে এ রকম করে আঁকবে। ঢাকায় কেউ এ মিডিয়ামে কাজ করে না। সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে একমাত্র আমিই এই মিডিয়ামে এতগুলো ছবি এঁকেছি।