সুশান্তের চিত্রকর্মে বনলতা
রাজধানীর বাংলামোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চিত্রশালার দেয়ালে নানা আকৃতির চিত্রকর্ম ঝুলছে। সব কটি চিত্রকর্মে নারীর অবস্থান। শিল্পী সুশান্ত কুমার অধিকারী এ ছবিগুলো এঁকেছেন। শিল্পীর ভাষায়, ‘এই নারীরা সবার মননে বাস করে। কখনো বনলতা, কমলা, কৃষ্ণকলি, লাবণ্য বা কখনো সাঁওতালি অথবা নার্গিস হয়ে কল্পনায় আবির্ভূত হয় আমাদের মনে। সাহিত্য বা কল্পনার এই নারী চরিত্রগুলো বাস্তবের প্রয়োজনের জন্য নয়, শুধু মনোজগতের নিঃস্বার্থ আনন্দ উপভোগের।’ এই ছবিগুলো নিয়ে গতকাল সোমবার শুরু হয়েছে শিল্পী সুশান্ত কুমারের একক প্রদর্শনী।
প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘বনলতা’। সোমবার সন্ধ্যায় শিল্পী সুশান্ত কুমারের একক চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক ও অভিনয়শিল্পী শম্পা রেজা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রদর্শনীর কিউরেটর চিত্রশিল্পী জাহিদ মুস্তফা। জীবনানন্দের ‘বনলতা’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান বেলায়েত হোসেন। সঞ্চালনা করেছেন মাহমুদা আক্তার।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক সুশান্ত কুমারের এটি প্রথম একক প্রদর্শনী। এখানে স্থান পেয়েছে ইদানীং তাঁর আঁকা ৩৭টি ছবি। সুশান্ত কুমার বলেন, ‘ছবিগুলোতে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ধারা অনুসরণ করিনি। আমি অন্যদের সবকিছু গ্রহণ করেছি, ছবি সৃষ্টিতে অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটিয়েছি নিজের মতো করে।’
তবে শুধু বিষয়কেই প্রাধান্য দেননি শিল্পী সুশান্ত অধিকারী, তার করণ কৌশলে যোগ করেছেন ভিন্নমাত্রা। চিত্রকর্মগুলোর মাধ্যম ও প্রকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জলরঙের বহুমাত্রিক রং আর রঙের ঔজ্জ্বল্য আবহ বিয়োগ করে, কম্পোজিশনে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে, কল্পনা আর বাস্তবতার সমন্বয়ে প্রাচ্য ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ন রেখে চিত্রপট রাঙিয়েছি। চিত্র জমিন প্রস্তুত করতে প্রচলিত ধারায় জলরং ব্যবহার করিনি। সাধারণ জলরং দীর্ঘ সময় পানিতে ভিজিয়ে রেখে কেমিক্যাল-জাতীয় দ্রব্যের শক্তি কমিয়ে এরপর চিত্রতলে ওপেক করে প্রয়োগ করেছি।’
এ প্রসঙ্গে প্রদর্শনীতে আসা শিল্পবোদ্ধাদের আলাপচারিতায় উঠে আসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসুর কথা। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঙ্গল স্কুলে ওয়াশ টেকনিকের প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর ছাত্র নন্দলাল বসু বিশ্বভারতীর কলাভবনে গিয়ে ওয়াশ টেকনিকের পাশাপাশি ওপেক রঙের ছবি এঁকে প্রাচ্য শিল্পকে ঋদ্ধ করেছেন। শিল্পী সুশান্ত অধিকারী প্রচলিত জলরঙের পদ্ধতি বাদ দিয়ে স্বতন্ত্র এক টেকনিক উদ্ভাবন করেন। শিল্পীর কাজের এ অভিজ্ঞতা তরুণ শিল্পীদের কাজে লাগবে বলে মন্তব্য করেন প্রদর্শনীতে আসা শিল্পবোদ্ধারা।
‘বনলতা’ প্রদর্শনীতে ঘুরে ফিরে বারবার জীবনানন্দের ‘বনলতা’ই প্রাধান্য পেয়েছে। শিল্পী সুশান্তর মতে, ‘বাঙালির কল্পলোকে কাব্যিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এক নারীর নাম বনলতা। আধুনিক সব কবির সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে জীবনানন্দের “বনলতা সেন” কবিতার বনলতা বর্ণনায় সবাইকে অতিক্রম করেছে।’
ক্যানভাসে বনলতা এসেছে নানাভাবে। একটি ছবিতে দেখা যায়, বনলতা নিজেই শিল্পী; এঁকেছেন জীবনানন্দ দাশকে। আরেক ছবিতে দেখা যায়, সহপাঠীদের নিয়ে দল বেঁধে ক্লাসে বসে ছবি আঁকছেন। সন্তান নিয়ে ঘুরে বেড়ান জাপানের কোনো চিত্রশালায়।
শুধু বনলতা নয়, রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য, কেটি, নিরুপমা, ক্যামেলিয়া, হৈমন্তী; নজরুল ইসলামের নার্গিস, সুনয়না; জীবনানন্দের সুচেতনা, সুরঞ্জনা, শ্যামলী, সুজাতা, শেফালিকা বোস ইত্যাদি চরিত্র মূর্ত হয়েছে শিল্পী সুশান্ত কুমারের ক্যানভাসে। এসেছে গ্রামের পথে ঘুঁটেকুড়ানি মেয়েটিও।
প্রদর্শনী চলবে ১৫ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা দুইটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত খোলা থাকবে প্রদর্শনী।