কোন দৃশ্য গাঢ় হয়ে আছে...

>

রাশিয়ার শহরগুলো ফাঁকা হতে শুরু করেছে। কারণ বিশ্বকাপ ফুটবলের বিদায়বেলা যে ঘনিয়ে এসেছে। কত স্মৃতি, কত রোমাঞ্চ, হাসি-কান্না, তর্ক-বিতর্ক, উল্লাস, বিবাদ পেরিয়ে বিশ্বকাপ উন্মাদনায় দাঁড়ি পড়তে যাচ্ছে। একদম বুঁদ হয়ে বিনোদন জগতের কয়েকজন তারকা এবারের ফুটবল ম্যাচগুলো দেখেছেন। অনেক খেলা তাঁদের মন ভেঙেছে, অনেকগুলো নিয়ে গেছে উত্তেজনার চরমে। কিছু মুহূর্ত লেগে আছে চোখে ও মনে, গাঢ় হয়ে বসে গেছে হৃদয়ে। বিশ্বকাপ ফুটবলের তেমনই কয়েকটি মনে রাখার মতো মুহূর্তের কথা বললেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের কয়েকজন তারকা—

দক্ষিণ কোরিয়া বনাম জার্মানি
চোখে লেগে থাকার মতো কিছু পাইনি
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের যে কটা খেলা হয়েছে, তাতে বড় দলগুলোর খেলা থেকে প্রত্যাশিত দারুণ কোনো মুহূর্ত বা চোখে লেগে থাকার মতো কিছুই খুঁজে পাইনি। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার গোলরক্ষক এইচ ডব্লিউ চোয়ের পারফরম্যান্স ছিল মনে রাখার মতো; বিশেষ করে বলব জার্মানির সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার খেলাটির কথা। কী দারুণ খেলল ছেলেটা। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে শেষ পর্যন্ত ধরাশায়ী বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। চোয়ের খেলাই মনে ধরেছে।

আরেকটি খেলাও দারুণ হয়েছে এবার। বেলজিয়ামের সঙ্গে আরেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের খেলাটি। টান টান উত্তেজনার এই খেলায় শেষ পর্যন্ত বেলজিয়ামের কাছে হেরেছে ব্রাজিল। আমার কাছে কখনো কখনো পর্তুগালের খেলাও চোখে ঝলক মেরে গেছে। তবে সব মিলিয়ে যেটা বলার সেটা হলো, এবারের বিশ্বকাপে ফেবারিট দলগুলো; যেমন আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানি, স্পেন—কেউই শেষ পর্যন্ত নেই। এই দলগুলো না থাকা মানে তো বিশ্বকাপ অনেকটাই ম্লান। তারপরও দারুণ ফুটবল খেলে আমাদের মতো ফুটবলপ্রেমী দর্শকের মন জয় করেছে ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়াম, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। এর বাইরে ভালো লেগেছে ফ্রান্সের খেলাও।

বেলজিয়াম বনাম জাপান
শাদলির গোল জাপানকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দেয়
সানী ও দুই সন্তান ফারদীন-ফাইজার মতো আমার পছন্দও ব্রাজিল। বিশ্বকাপের প্রায় সব খেলা পরিবারের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেখেছি। ব্রাজিল বিদায় নেওয়ায় মন খারাপ হয়েছিল। খেলার অনেক দৃশ্য নজর কাড়লেও খেলার বাইরে একটা দৃশ্য অনেক দিন মনে থাকবে। জাপান ও বেলজিয়ামের খেলার দিন ঘটনাটি ঘটেছিল। শুরুতে জাপান দুই গোলে এগিয়ে ছিল। খেলা শেষ হয় ৩-২ গোলে। শেষ মুহূর্তে বেলজিয়ামের শাদলির দেওয়া গোল জাপানকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু এর পরও গ্যালারিতে থাকা জাপানি দর্শকেরা নিজেদের মানবিক দিক ভুলে যাননি। তাঁরা যেভাবে গ্যালারি পরিষ্কারের কাজটি মন দিয়ে করছিলেন, তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এই দৃশ্যটি আমার চোখে লেগে থাকবে বহুদিন।

ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনা
এমবাপ্পের গোলটা ছিল অসাধারণ
বিশ্বকাপে আমার প্রিয় দল ব্রাজিল। শুধু আমার নয়, পুরো পরিবারই ব্রাজিলের সমর্থক। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে আমার প্রিয় দল ভালো কিছু করে দেখাতে পারেনি। নতুন নতুন খেলোয়াড়ের খেলা আমাকে মুগ্ধ করেছে। নতুন কিছু দলও যারা এত দিন বড় চমক দেখাতে পারেনি, তারা চমকে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত একটা দৃশ্য আমার চোখে লেগে আছে। আর সেটা হচ্ছে শেষ ষোলোতে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের মধ্যকার খেলার সময় ফ্রান্সের এমবাপ্পে দ্রুতগতিতে যেভাবে প্রথম গোলটা করেছেন। পরের গোলটাও ছিল অসাধারণ। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম মাত্র ৫ মিনিটে জোড়া গোল করে ৫০ বছরের পুরোনো রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেন এমবাপ্পে। এমবাপ্পের চেহারায় এখনো শৈশবের সেই মায়া লেগে আছে। এই চেহারা নিয়ে বল পেলেই যেভাবে অবিশ্বাস্য গতিতে প্রতিপক্ষের রক্ষণ তছনছ করে ফেলতে পারেন, সেই ক্ষমতা এবার আর কারও মধ্যে আমি দেখিনি। ১৯ বছর ৬ মাস বয়সী এই ফরোয়ার্ড আগামী দিনে পৃথিবীর একজন সুপারস্টার।

ব্রাজিল বনাম কোস্টারিকা
সেই কান্না আমাকেও প্রভাবিত করেছে
এবারের বিশ্বকাপ আমাকে প্রতি মুহূর্তে অবাক করেছে, কিন্তু খুশি করতে পারেনি। জনপ্রিয় অতি চর্চিত কোনো দলের খেলাই আমার নজর কাড়েনি; বরং ইউরোপের দলগুলো চমক দেখিয়েছে। তবুও একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের কথা বলতে গেলে, আমি কোস্টারিকার বিপক্ষে নেইমারের দেওয়া সেই গোলটার কথা বলতে চাই, যেটা দেওয়ার পর নেইমার আবেগী হয়ে পড়েছিলেন। সেই কান্না আমাকেও প্রভাবিত করেছে। নেইমারের জন্য ওই গোলটা খুবই প্রয়োজন ছিল। ওটার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল হার-জিত, নেইমারের সম্মান, দলের সম্মান। পাশাপাশি নেইমারের সঙ্গে যুক্ত দাতব্য কার্যক্রমগুলোর ভবিষ্যৎও। তাই সেই মুহূর্তটি ছিল দেখার মতো, মনে গেঁথে থাকার মতো। আর ব্রাজিলের গাব্রিয়েল জেসুস নামের ছোট্ট ছেলেটা তো আমার মন কেড়ে নিয়েছে। তাকে যতবার দেখেছি দারুণ পাস দিতে, ততবারই আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।

ব্রাজিল বনাম সুইজারল্যান্ড
প্রথম গোল, প্রথম উল্লাস, প্রথম চিৎকার
এবাররের বিশ্বকাপ তো আসলে আনপ্রেডিক্টেবল (অভাবনীয়) ছিল। মোটামুটি ফেবারিট যারা ছিল তারা চলে গেছে।
আমি বিশেষ করে ব্রাজিল বনাম সুইজারল্যান্ডের ম্যাচের কথা বলব। ব্রাজিলের সেই প্রথম ম্যাচের প্রথম গোলটা। কুতিনহো গোলটা করেছিল। মোটামুটি ডি বক্সের বাইরে থেকে শট নিয়ে একটা গোল দিল। প্রথম গোলের পর খুবই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি। প্রথম গোল, প্রথম উল্লাস, প্রথম চিৎকার। আরেকটা রোমাঞ্চকর মুহূর্ত হচ্ছে ব্রাজিলের শেষ খেলাটা। বেলজিয়ামকে অনেক শক্তিশালী দল বলা হলেও ব্রাজিল বেলজিয়ামের সঙ্গে যেভাবে খেলছে সেটা একদম টান টান উত্তেজনায় ভরপুর। ওই দিনটা আসলে ব্রাজিলের ছিল না। এত গোল হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্বেও তাঁরা গোল করতে পারেনি। ক্রিকেটে যেমন ‘ক্যাচ মিস তো ম্যাচ মিস’ ফুটবলেও সুযোগ মিস হলে আসলে জেতা যায় না। আমি বলব না যে, ওরা খুব দুর্বল টিম। কারণ খেলাজুড়ে মনে হয়েছিল, এই বুঝি গোল হয়ে যাবে।

বেলজিয়াম বনাম ব্রাজিল
রক্ষণ একটি শিল্প
ফুটবলে রক্ষণটাও যে একটা শিল্প, এটা এবারের বিশ্বকাপে একটা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। আগে কিন্তু আমরা আক্রমণকে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতাম। গোল দেওয়াকে একটা শিল্প বলতাম। এই বিশ্বকাপে এসে বিভিন্ন দিক থেকে সেই গতানুগতিক চিন্তায় বদল এসেছে। রক্ষণ একটি শিল্প এবং গোল দেওয়ার মতো গোল ঠেকানোর কাজটাও হতে পারে দারুণ শৈল্পিক। এই রক্ষণের কাজটা যে শুধু রক্ষণভাগের খেলোয়াড়েরাই করছেন, এমন নয়। এবারের খেলাগুলোয় দেখছি মাঝমাঠের হোল্ডিং ডিফেন্ডাররাও দারুণ শৈল্পিকভাবে বিপক্ষ দলের খেলাকে নষ্ট করে দিচ্ছেন।

বেলজিয়াম বনাম ব্রাজিলের খেলাটার দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যাবে বিপক্ষ দলের খেলাকে যে মাঝমাঠে নষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁর নাম মারুয়ানে ফেলাইনি। এই ফেলাইনির কারণে ব্রাজিলের ডগলাস কস্তা নামার আগ পর্যন্ত মাঝমাঠটায় ছিল বেলজিয়ামের আধিপত্য।

গ্রন্থনা: আনন্দ প্রতিবেদক। ছবি: রয়টার্স ও প্রথম আলো