মুভি, বন্ধন ও ক্যান্টন চায়নিজ!

‘এতটুকু আশা’ ছবিতে অভিনয় করেন রাজ্জাক
‘এতটুকু আশা’ ছবিতে অভিনয় করেন রাজ্জাক

‘মুভি’ মানে মোটা দাগে সিনেমা হলে চলা সিনেমা। ইংরেজি ‘মুভ’ থেকেই ‘মুভি’ কথাটি এসেছে। অর্থাৎ যে চিত্র চলে। তাই বাংলায়ও একে চলচ্চিত্র বলে। অন্য নামও আছে। মোশন পিকচার, মুভিং পিকচার, সিনেমাটোগ্রাফি। চিত্র আগে শুধু স্থির ছিল। পরে বিজ্ঞানীরা স্থির চিত্রকে ধারাবাহিকভাবে ফিতার ওপর বসিয়ে স্পিডে চালিয়ে দেন। স্থির চিত্র চলতে শুরু করে। আর এই চলমান চিত্রে মুভি নির্মাতারা প্রাণবন্ত গল্প, সংলাপ, মিউজিক যোগ করে পরিচয় ঘটান এক নতুন বিনোদন মাধ্যমের। চলতি ভাষায় ‘সিনেমা’ বলেই আমরা বুঝিয়ে দিচ্ছি পুরো বিষয়টিকে।

‘সিনেমা হল’ নামের এক জাঁকজমকপূর্ণ বিনোদনকেন্দ্রে চলে এসব সিনেমা। কালের পথচলায় বাংলাদেশেও এসে হাজির হয় সিনেমা। বহু বহু দশক আগে। সিনেমা হলগুলোর আলাদা আলাদা নাম থাকে। যেমন বলাকা, মধুমিতা, অভিসার, গুলিস্তান, শাবিস্তান। দল বেঁধে টিকিট কেটে সেই সিনেমা হলগুলোয় সিনেমা দেখতে যায় বিনোদনপ্রেমী মানুষ। দেড় থেকে আড়াই ঘণ্টার এই সিনেমায় থাকে মজার কাহিনি, নামীদামি অভিনেতা-অভিনেত্রী, পাকা হাতের নির্দেশনা। বড় পর্দায় তা দেখে ফুরফুরা এক বিনোদন মাথায় নিয়ে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আসে দর্শক।

চিন্তাবিদেরা এ নিয়ে একটু অন্যভাবে ভেবেছেন। শুধুই কি গল্প কাহিনি পর্দায় দেখতে যায় দর্শক? গল্প কাহিনি তো সমাজের মধ্যেই আছে। তবে? তবে সুন্দরভাবে বানানো একটি ছবি দেখতে? উঁহু, তাহলে তো একা একা ঘরে বসেই দেখা যায়, দল বেঁধে টিকিট কেটে সিনেমা হলে গিয়ে কেন?

আমি ক্লাস টুয়ে পড়ার সময় প্রথম ‘মুভি’ নির্মাণ আর তা প্রদর্শন করি। বাসায় জুতার বাক্সের দুই মাথা ফুটো করে। সামনের ফুটোটা চারকোনা। পেছনের ফুটো দিয়ে বাক্সে ২০০ ওয়াটের ইলেকট্রিক বাল্ব ঢোকাই। বড় লিভিং রুমের দেয়ালে চারকোনা এক বড় লাইট ইমেজ ফুটে ওঠে সিনেমার পর্দার মতো। এবার জুতার বাক্সের ওপরে কেটে রাখা প্যাসেজ দিয়ে একটা স্টিল ফটোর নেগেটিভ ঢুকিয়ে দিই। সামনের পর্দায় ভূতের মতো ইমেজ ভেসে ওঠে। এ বিষয়ে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে আমাকে সহযোগিতা করে বাসার কাজের ছেলে জামাল। আম্মাকে ডেকে এনে চেয়ারে বসাই। বলি, ভূতের মুভি দেখাব। আম্মা খুব গম্ভীরভাবে আমার ছবি দেখতে বসেন। ভুতুড়ে নেগেটিভ নাড়াচাড়া করে পজিটিভ গল্প বলতে থাকি মুখে বানিয়ে বানিয়ে। আম্মা হাসেননি। সিরিয়াস ছিলেন। আজ পরিণত বয়সে বুঝি, আম্মা তার ছোট্ট ‘আলফ্রেড হিচকক’কে নিরুৎসাহিত করতে চাননি। তিনি তখন স্কুলশিক্ষিকা ছিলেন।

তবে আমার এই ‘জুতার বাক্স প্রজেক্টরের’ জন্য দায়ী ছিলেন আমার নানি ও নায়করাজ রাজ্জাক। নাটোরে আমার নানাবাড়ি। ছোট্ট শহর নাটোর, টমটমের শহর নাটোর। মূল কাঁচাগোল্লার দোকানের উল্টো দিকেই ছায়াবাণী সিনেমা হল। ছুটিতে নানাবাড়ি বেড়াতে গেছি। নানি হচ্ছেন মুভির পোকা। শুক্রবার ডিনারের পর নাইট শোতে আম্মা-খালা-মামা, প্রতিবেশী মাসি-পিসিসহ মিছিল নিয়ে সিনেমা হলে ঢুকলেন। আমিও কোলে। ছবির নাম ‘এতটুকু আশা’। মফস্বলের আলো-আঁধারির রাতে প্রাসাদের মতো আলো ঝলমল সিনেমা হলকে আমার রূপকথার রাজ্য মনে হয়েছিল। আরও ভালো লেগেছিল, রাত ১২টায় ফেরার সময়। নির্জন শহরে টুংটাং শব্দে কয়েকটা রিকশার বহরে বাসায় ফিরে মনে হলো সবাই কোনো অভিযান সেরে ফিরেছি। তাহলে কি শুধুই রাজ্জাক-সুজাতা দেখতে যাওয়া? আলো ঝলমল সিনেমা হলে ঘণ্টা তিনেক কাটানো? এই যে সবার এক আনন্দের বন্ধন, এটা কিছুই না?

ঢাকায় চাচাতো বোনেরা ইংরেজি ব্র্যান্ডেড ত্যান্দোড়। তাদের ইংরেজি মুভি দেখায় স্কুলবয় আমি বডিগার্ড। অভিসার হলে গেলাম হলিউডের ‘ডার্টি হ্যারি’ দেখতে। ৫ বোন ১ ভাই। কী সুন্দর হইহুল্লা করে মুভি দেখলাম, বের হলাম, সুন্দরীদের দেখে কেউ কোনো টিজ করল না। বরং আদবকায়দা বজায় রাখল, রিকশা ঠিক করার সময় মেয়ে দেখে আগে ছাড় দিল। ফেরার সময় মধুমিতা হলের টাই টুং চায়নিজে স্যুপ-চওমিন খেয়ে বাসায় ফিরলাম একরাশ আনন্দ নিয়ে। পথে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে চুড়ি-কানের দুল কিনতে ভুলল না বোনগুলো। তাহলে সেটা শুধুই হলিউডের নায়ক ক্লিন্ট ইস্টউডকে দেখতে যাওয়া? হ্যাং আউট আর বন্ধনের আনন্দ উচ্ছ্বাস, সেগুলো ফাও? ফেরিওয়ালা কি সামান্য সময়ের জন্যও ক্লিন্ট ইস্টউডের মতো আনন্দ দেয়নি? ক্লিন্ট ইস্টউড অভিনয় দিয়েছিল, চুড়ি-কানের দুল তো দেয়নি।

মুভি দেখার সঙ্গে আপনজনের মায়ার বন্ধনের একটা যোগাযোগ আছে। একা একা মুভি মানুষ কমই দেখে। আর মায়ার সঙ্গে সঙ্গে মুভি দেখায় যোগ হয়েছে চায়নিজ রেস্তোরাঁ। এটা চাতুরতার সঙ্গে যোগ করে দেয় গত শতকের ৬০ ও ৭০ দশকে ঢাকায় রেস্তোরাঁ ব্যবসা করতে আসা কিছু চীনা পরিবার। তারাই এ দেশে নতুন এক জনপ্রিয় ফুড কালচার চালু করে, ‘চায়নিজ ফুড’। এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আব্বা আমাদের পরিবারকে নিয়ে যান মধুমিতায়। বুলবুল আহমেদ অভিনীত ‘সূর্যকন্যা’ দেখাতে। মুভি শেষে এক চায়নিজ রেস্তোরাঁয় ঢুকি। আহ, কী পরিবেশ! লালাভ আলো-আঁধারিতে জলতরঙ্গের চায়নিজ মিউজিক। রেস্তোরাঁয় ঢোকা মাত্র চায়নিজ ফুডের এক বিশেষ সুঘ্রাণে মন চনমনে হয়ে ওঠে।

পরদিন কলেজপড়ুয়া বড় ভাইয়ের সঙ্গে রিকশা করে মোহামেডানের ফুটবল খেলা দেখতে যাচ্ছি। মগবাজারে আসতেই তিনি রিকশা থামান। এক পুরোনো ডিজাইনের হলদেটে দোতলা বাড়ি দেখিয়ে বলেন, ‘বল তো, এটা কী?’ কী হতে পারে? পুরোনো একটি বাড়ি। ছাদের দড়িতে স্কার্ট, গেঞ্জি, শর্টস, পায়জামা রোদে শুকাতে দেওয়া। বললাম, ‘কী জানি?’ বললেন, ‘এইটাতেই আমরা কাল রাতে চায়নিজ খেয়েছিলাম।’ অবাক হয়ে বললাম, ‘ধুর!’ আমার ধুর-এ হাত ধরে বাড়ির গেটের ভেতরে নিয়ে গেল সে। দেখি নিচতলার দরজায় OPEN ঝোলানো, ওপরে চায়নিজ অক্ষর, নিচে ইংলিশে লেখা, ক্যান্টন চায়নিজ রেস্টুরেন্ট। ভেতরে ঢুকে আরও টাশকি। গত রাতের সেই জলতরঙ্গ, সেই সুঘ্রাণ, সেই পরিবেশ!

চীনা ম্যানরা মানুষের পালস ভালো বোঝে। ওরা জানে, সিনেমা দেখলে খিদে লাগে। তিন ঘণ্টার ধাক্কা। সিনেমা দেখতে আসে প্রেমিক-প্রেমিকা, নতুন জামাই-বউ, বন্ধু-বান্ধবী, পরিবার। তাই তারা প্রত্যেক সিনেমা হলের পেটে জুড়ে দিয়েছিল একটি করে চায়নিজ রেস্তোরাঁ। গুলিস্তান হলে ‘চু চিন চৌ’, মধুমিতায় ‘টাই টুং’, বলাকায় ‘ইফা’ আর ‘বাং চিং’। যেন ক্যাঙারুর পেটে পেটে পান্ডার বাচ্চা। মুভি দেখবে আর খেয়ে যাবে না, তা হবে না, তা হবে না।

সুখের পিঠে দুঃখ থাকে। নিচু মানের মুভির জোয়ারে ভদ্র মানুষ সিনেমা হল ছেড়েছিল। লোকসান গুনতে লাগল সিনেমা হলগুলো। এলিফ্যান্ট রোডের মল্লিকা হল হয়ে গেল বাণিজ্যিক মার্কেট। জেনে রাখা ভালো, ঢাকা তথা বাংলাদেশের প্রথম চায়নিজ রেস্তোরাঁ ‘চু চিন চৌ’য়ের জন্ম হয়েছিল গুলিস্তান হলেরই পেটে।

এখন ভালো মুভি করতে হবে। ভালো মুভি না হলে সিনেমা হল হয়ে যাবে মার্কেট, মায়ার বন্ধন হয়ে পড়বে বাণিজ্যিক। আর ক্যান্টনের চীনা খাবার? ওর বদলে খেতে হবে শাড়ির রং মেশানো সস দিয়ে ফরমালিন মেশানো ‘সুইট অ্যান্ড সাওয়ার প্রন!’