চোখ জুড়ানো অ্যাক্রোবেটিক

কখনো একক, কখনো দ্বৈত, আবার কখনো দল বেঁধে জাতীয় নাট্যশালার সুবিশাল মঞ্চটিকে ব্যবহার করেছে
কখনো একক, কখনো দ্বৈত, আবার কখনো দল বেঁধে জাতীয় নাট্যশালার সুবিশাল মঞ্চটিকে ব্যবহার করেছে

অনুষ্ঠানের মধ্যে নেপথ্য থেকে উপস্থাপক ঘোষণা দিলেন, শেষ আপনাদের জন্য চমক আছে। কিন্তু দর্শক সেই চমকের জন্য অপেক্ষা করেছেন বলে মনে হলো না, একের পর এক চোখ ধাঁধানো চমক তখন মঞ্চেই ছিল। এক শব্দে বলতে গেলে ‘চমৎকার’। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালার আয়োজনটি মিলনায়তনে থাকা দর্শকদের মন এবং চোখ দুটিই জুড়িয়েছে।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও চীন সরকারের সহযোগিতায় এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় দশজন অ্যাক্রোবেটিক শিল্পী এক বছরের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে একাডেমির একটি বড়দের দল এবং একটি ছোটদের দল সারা দেশে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আয়োজনে অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো দর্শনীর বিনিময়ে অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনীর আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।

কখনো একক, কখনো দ্বৈত আবার কখনো দল বেঁধে জাতীয় নাট্যশালার সুবিশাল মঞ্চটিকে ব্যবহার করেছে ৩৫ জন শিল্পী। অ্যাক্রোবেটিক দলের সদস্যরা জলি সিমেন্স, হ্যান্ড স্কিল, আংকারাসা, ওয়ার ব্যালেন্স, চেয়ার সিটিং, রিং জাম্প, ফায়ার ড্যান্সসহ ২০টি বিষয়ে নিয়ে সার্কাস প্রদর্শনী করেন। প্রায় শেষ দিকে মঞ্চে আসে শামীমা ও সৌরভ। বাংলার গানের সুরের সঙ্গে রীতিমতো মঞ্চের ওপর ভেসে ভেসে কসরত দেখান এই জুটি।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ছিল শামীমা ও সৌরভের দ্বৈত পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ছিল শামীমা ও সৌরভের দ্বৈত পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো

মায়ের সঙ্গে প্রদর্শনী দেখতে এসেছিল শিশু সামিন। আয়োজন শেষ হলেও মিলনায়তন থেকে বের হতে চায়নি সে। আরও দেখবে। মা মাহবুবা লিপি বললেন, ‘এত দিন টিভিতে সার্কাস, কার্টুন দেখেছি। আজ সত্যি সত্যি সার্কাস দেখে ছেলে আমি দুজনই মুগ্ধ। এমন আয়োজন শহরে নিয়মিত হওয়া উচিত।’ প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন দেখে খবর নিয়ে টিকাটুলি এলাকার মালিহা আইয়ুব তাঁর ছোট দুই ভাইকে নিয়ে এসেছিলেন। মালিহা বলেন, ‘আগে বুঝিনি এত সুন্দর আয়োজন দেখতে পাব। তাহলে আসার আগে বাসার অন্যদেরও নিয়ে আসতাম।’

অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনীর উপস্থাপক সুজন মাহবুব জানান, নিয়মিতভাবেই এ দলটি দেশের বিভিন্ন জায়গায় অ্যাক্রোব্যাট পরিবেশন করছে। গতকালই প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে অংশ নেয় তারা। গতকাল ছিল ৪৪১তম প্রদর্শনী।

এই শিল্পীরা চীন থেকে এক বছর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে
এই শিল্পীরা চীন থেকে এক বছর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে

অনুষ্ঠান শেষে কথা হয় একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সঙ্গে। পুরো আয়োজনটি তাঁরই পরিকল্পনা ও পরিচালনায়। দর্শক সারিতে বসে দেখেছেন দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠানটি। শেষে মঞ্চে উঠে শিল্পীদের শুভেচ্ছা জানান। লিয়াকত আলীর কাছ থেকে জানা গেল একাডেমির চলমান এই বড় এবং ব্যতিক্রম কর্মসূচির আদ্যোপান্ত। ১৯৯৪ সালে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় ‘ফাইন অ্যান্ড পারফরম্যান্স আর্ট প্রশিক্ষণ’ প্রকল্পের আওতায় শিল্পীদের প্রশিক্ষণ ও সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য রাজবাড়ীতে অ্যাক্রোবেটিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু ২০০০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অর্থের অভাবে অ্যাক্রোবেটিক দলের শিল্পীদের শারীরিক কসরত প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যায়। পরে লিয়াকত আলী নিজে উদ্যোগ নিয়ে রাজবাড়ী অ্যাক্রোবেটিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আওতায় নিয়ে আসেন এবং বড়দের একটি অ্যাক্রোবেটিক দল গঠন করেন। দলটির নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি অ্যাক্রোবেটিক দল’। এরপর ২০১২ সালে প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ‘দেশজ সংস্কৃতির বিকাশ ও আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন’ কর্মসূচির আওতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বড়দের ১০টি প্রদর্শনী এবং দুটি শিশুদের অ্যাক্রোবেটিক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। প্রথমটি অ্যাক্রোবেটিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রাজবাড়ীতে অনুষ্ঠিত হয় ৫০ জন শিশুকে নিয়ে এবং দ্বিতীয়টি ৭২ জন শিশু নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশের ৬৪টি জেলায় এবং ঢাকার বিভিন্ন স্থানে মোট ৯৩টি প্রদর্শনী সম্পন্ন করা হয়।

ছিল নানা বয়সী শিল্পীদের পরিবেশনা
ছিল নানা বয়সী শিল্পীদের পরিবেশনা

২০১৪-১৫ অর্থবছরে আবারও অ্যাক্রোবেটিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রাজবাড়ীর জন্য বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়ায় আবারও অ্যাক্রোবেটিক দলের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। দলের শিল্পীদের মনোবল ভেঙে যায় এবং তাঁদের মধ্যে অনেকে বাধ্য হয়ে এই পেশা ছেড়ে কল-কারখানায় চাকরি নেন। কিন্তু বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির রাজস্ব খাত থেকে অর্থ বরাদ্দ করে তাঁদের দিয়ে বিভিন্ন জেলায় প্রশিক্ষণ দেন। এ ছাড়া শিল্পীদের শারীরিক সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নিয়মিত কর্মশালা এবং প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রশিক্ষণ প্রদান এবং কর্মশালার জন্য তাদের সম্মানী দেওয়া হয়। ফলে দলটি ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা পায়।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও চীন সরকারের সহযোগিতায় এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় ২০ জন অ্যাক্রোবেটিক শিল্পী এক বছরের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে দেশে ফিরে প্রদর্শনী করছে এবং আরও ১০ জন শিল্পী এক বছরের প্রশিক্ষণে চীনে অবস্থান করছেন।

অনুষ্ঠানের মাঝে উপস্থাপক সুজন মাহবুব ঘোষিত চমকটি শেষে জানালেন মহাপরিচালক লিয়াকত আলী। এরপর চীনে গিয়ে শিল্পীরা টানা তিন বছর প্রশিক্ষণ নেবেন।