জীবনের সব গল্প নাটকের গল্প হয় না

বউ আমার নাটকের দৃশ্য
বউ আমার নাটকের দৃশ্য

১৩ জুলাই শুক্রবার, দুটি চ্যানেলে পরপর প্রচারিত হলো দুটি সাপ্তাহিক নাটক। এ নাটক দুটি আমাদের এবারের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এ দিন রাত নয়টায় এটিএন বাংলায় প্রচারিত হলো নাটক ছুঁয়ে যায় দিগন্ত। রচনা ও পরিচালনা করেছেন আনিসুজ্জামান এবং অভিনয় করেছেন ইমন, ঈশানা, তানভীর প্রমুখ। নাটকে যে গল্পটি তুলে ধরা হয়েছে, একে গল্প বলা যায় কি না, সেটাই সন্দেহ। দুটি মেয়ে আর দুটি ছেলে সাগরপাড়ে বেড়াতে এসেছে। ছেলে দুটি এসেছে অফিসে মিথ্যা বলে ছুটি নিয়ে, আর মেয়ে একজন বাড়িতে বিয়ের কথা বলায় পালিয়ে এসেছে, আরেকজন এসেছে তাকেই খুঁজতে। এটুকুই গল্প। এরপর প্রতিদিন তাদের সাগরপাড়ে দেখা হচ্ছে, গদগদ প্রেমের সংলাপ হচ্ছে, অনাবশ্যক ভাঁড়ামি হচ্ছে, এরপর একসময় প্রেম নিবেদন, পরস্পরের হাত ধরা ও যবনিকা। এই হলো গল্প।

বলা হয়েছে নাটক, অথচ ঘটনায় কোনো ক্ষোভ নেই, আক্ষেপ নেই, বিরহ নেই, সংকটও নেই, একেবারে নিটোল গল্প। এমন নিটোল আর সরল-তরল জীবন হয়তো বাস্তবে থাকে, কিন্তু সেই জীবন নিয়ে যে নাটক বা উপন্যাস হয় না, তা বোধ হয় লেখক ও নির্মাতা জানেন না। দু-একটি দৃশ্যের কথা বলা যাক, সাগরপাড়ে ঈশানাকে দেখে তানভীর ও ইমন যেভাবে পরি পরি বলে গদগদ হয়েছে, তা দেখে হাসব, নাকি কাঁদব, বুঝতে পারছিলাম না। আবার দুই বন্ধু একই অজুহাত দেখিয়ে বসকে মিথ্যা বলে যে ভাষা ও সংলাপে ছুটি নিয়েছে, তা বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। মনে হয়েছে ভাঁড়ামি। অন্যদিকে যে মেয়ে নাটকের শুরু থেকেই প্রেমের জন্য উদ্‌গ্রীব, একটা সংলাপ শুনেই ইমনের হাত জড়িয়ে ধরেছে, সে মেয়ে বিয়ের কথা বলায় বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে! এ সবকিছুই মনে হয়েছে অবিশ্বাস্য ও অযৌক্তিক। এ ছাড়া নাটকের শেষ দুটি সংলাপের কথা আলাদা করে বলা যায়। যখন ছেলেটি বলল, ‘আমার চাকরি চলে গেছে,’ তখন মেয়েটি তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘চিরদিন এমনই হয়।’ সংলাপের উত্তরে এটা কেমন সংলাপ—কিছুই বুঝলাম না। নাটকের নাম দেওয়া হয়েছে ছুঁয়ে যায় দিগন্ত।কিন্তু নাটকের বিষয় বা চরিত্রের সঙ্গে এ নামের কী সম্পর্ক, তা-ও বুঝলাম না। অভিনয়ের মানের কথা না বলাই ভালো।

একই দিন রাত ১০টায় একুশে টিভিতে প্রচারিত হয়েছে বউ আমার। রচনা ও পরিচালনা করেছেন সাজিন আহমেদ। অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম, অপর্ণা, সুজিৎ বিশ্বাস, বৈদ্যনাথ সাহা, ওয়াহিদুল ইসলাম, শহীদুল্লাহ প্রমুখ। নাটকের শুরু থেকেই দেখানো হয়েছে মোশাররফ করিম একজন সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ। সে চাঁদাবাজি করে তার বউয়ের পরিচয় দিয়ে। কারণ, তার স্ত্রী এলাকার রাজনৈতিক নেত্রী। তার স্ত্রী একের পর এক অভিযোগে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। মোশাররফ করিম দোকানে, হোটেলে, নির্মাণকাজে ও স্কুলে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, স্ত্রীই তাকে ছাড়িয়ে আনে। তারপর শেষে হঠাৎ ডিবি অফিস থেকে ফোন আসে তার স্ত্রীর কাছে। বলা হয়, আপনার স্বামী একজন সমাজসেবী পুলিশ অফিসার। সমাজে নারী পাচারকারী ও অন্যদের ধরতে তাকে চাকরিহারা, বেকার ও চাঁদাবাজ সাজানো হয়েছে। শুনে স্ত্রী অভিভূত হয়ে শেষ দৃশ্যে স্বামীকে বিছানায় জড়িয়ে ধরেছে। লেখক-নির্মাতা বোধ হয় ভেবেছেন দর্শক একেবারেই নির্বোধ ও বোকা, যেন ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানেন না। কিন্তু দর্শককে এত বোকা ভাবা কি ঠিক? এত মহৎ মানুষকে চাঁদাবাজের অভিনয় করাতে গিয়ে আপনি রুটি-বিস্কুটের দোকানে ও পথেঘাটে যেভাবে চাঁদাবাজ হিসেবে দেখালেন, আর শেষে শোনালেন নারী পাচারকারীদের ধরার গল্প—বিষয়টি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। আবার মোশাররফ এমন ডিবি যে তার ব্যক্তিপরিচয় শাগরেদেরা তো জানেই না, স্ত্রীও জানে না! এটিও যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। আর শেষ দৃশ্যে ডিবি অফিস থেকে চাঁদাবাজ স্বামীর সমাজসেবী পরিচয় শুনে স্ত্রী অপর্ণা বিছানায় স্বামীকে যেভাবে জড়িয়ে ধরেছে, তা বড়ই বেমানান ও সস্তা সিনেমার সাজানো দৃশ্যের মতো মনে হয়েছে। শেষে বলব, নাটকটিতে মোশাররফ করিমের যে অভিনয় দেখাতে চেয়েছেন নির্মাতা, তা একেবারেই মুখস্থ হয়ে গেছে দর্শকের। দর্শক এখন এতটা নির্বোধ নেই। বরং নির্মাতাদের বলব, মোশাররফ করিমকে নতুন আর কীভাবে উপস্থাপন করা যায়, সে চিন্তা করুন। একই অভিব্যক্তি ও অভিনয় দেখতে দেখতে আমরা সাধারণ দর্শকেরা ক্লান্ত ও বিরক্ত।

এই হলো আমাদের বর্তমান টিভি নাটকের হালচাল। এ ছাড়া ধারাবাহিক নাটকের কথা তো বাদই রেখেছি। এবার সরাসরি প্রচারিত একটি গানের অনুষ্ঠান দিয়ে আমরা শেষ করব আলোচনা। অনুষ্ঠানটির নাম ‘এশিয়ান মিউজিক’। প্রচারিত হলো ১৫ জুলাই রাত ১১টায়। এ দিন শিল্পী ছিলেন লুইপা ও অপু। উপস্থাপনায় সাবিনা। শিল্পী দুজন প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী পালাক্রমে গান করেছেন এ অনুষ্ঠানে।

লুইপার উল্লেখযোগ্য পরিবেশনার মধ্যে ছিল, ‘তুমি আমার কত চেনা, সে কি জানো না’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘তুমি আমার এমনই একজন’ ইত্যাদি। আমরা আগেই বলেছি, লুইপার কণ্ঠ মিষ্টি ও সুরেলা। তাঁর পরিবেশনাও ছিল স্নিগ্ধ ও আন্তরিকতাপূর্ণ। কিন্তু একটি অপূর্ণতা হলো, তিনি কেবল অন্যের জনপ্রিয় গানই করেছেন, নিজের কোনো গান করেননি, যেটা এ ধরনের অনুষ্ঠানে শিল্পীর কাছে দর্শক-শ্রোতাদের প্রত্যাশা। অপু অবশ্য সে প্রত্যাশা কিছুটা পূরণ করেছেন। তিনি অন্যের জনপ্রিয় গানের পাশাপাশি দু-একটি নিজের গানও গেয়েছেন। তাঁর কণ্ঠ একটু হালকা হলেও সুরেলা ও মিষ্টি। তাঁর উল্লেখযোগ্য পরিবেশনার মধ্যে ছিল ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘যেয়ো না সাথি, চলেছ একেলা কোথায়’ ইত্যাদি এবং নিজের গান ‘আজ দৃষ্টি যে ক্ষীণ, আমি তুমিহীন’।

তবে অনুরোধ থাকল, অনুষ্ঠান উপস্থাপনার বেলায় যেন বিশেষ নজর দেওয়া হয়।