খলনায়কগণ!

গোলাম মুস্তাফা, খলিল, জাম্বু, রাজিব, হুমায়ুন ফরীদি, জসিম, মিশা সওদাগর, রাজু আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
গোলাম মুস্তাফা, খলিল, জাম্বু, রাজিব, হুমায়ুন ফরীদি, জসিম, মিশা সওদাগর, রাজু আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

খলনায়ক মানে ভিলেন। ভয়ংকর কেউ। কিছু কিছু বাংলা শব্দ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইংলিশ হয়ে যায়। যেমন কেদারা হয়েছে চেয়ার, দূরালাপনী হয়েছে ফোন। ভিলেন তেমনই। ভিলেন বাস্তবে থাকে, মুভিতে থাকে, নাটকে থাকে, যাত্রাপালায় থাকে। ভিলেন মানেই ভয়ংকর কেউ। কোনোভাবেই পজিটিভ না, নেগেটিভ, শয়তানি করাই যার কাজ। হেন খারাপ কাজ নাই, যা ভিলেন করে না। খুন-লুটপাট থেকে ধর্ষণ, সব।

বাংলা মুভিতে ভিলেন অপরিহার্য চরিত্র। ভিলেন আর সব খারাপ কাজের সঙ্গে সঙ্গে যে কাজটা করবেই, নায়ক-নায়িকার প্রেমে বাগড়া দেবে। ভিলেনের চারদিকে বিভিন্ন মেয়ে থাকলেও তার লোভ নায়িকার দিকেই। ব্যস, শুরু হবে নায়কের সঙ্গে তার সংঘর্ষ। আগুন ছাড়া যেমন পানি সেদ্ধ হয় না, ভিলেন ছাড়া তেমন নায়ক সেদ্ধ হয় না। ভিলেন যত শক্ত হবে, নায়ক তত পোক্ত হবে।

সিনেমার কাহিনির মতোই ভিলেনের প্যাটার্ন কালচার অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে। এই উপমহাদেশের ফিল্ম জগতে বহু দশক ধরেই ভিলেন ভীষণ দামি ও দর্শকপ্রিয়। যদিও সিনেমা হলে দর্শক ভিলেনের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে, বাস্তবে দেখা হলে ঠিক তার উল্টো। ভিলেনের কাছে যেতে হুড়োহুড়ি লাগায়, ছুঁয়ে দেখে। কারণ, ভিলেন চরিত্রের অভিনেতারা খুব উঁচুমানের। তাঁরা বাস্তবে জনপ্রিয় হন।

স্বাধীনতার পর আমাদের বাংলা মুভিতে এক জাঁদরেল ভিলেন উদয় হন। রাজু আহমেদ। কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বিটিভির পুরোনো দিনের সাদা-কালো ছবিতে তাঁকে দেখে মুগ্ধ হই। ভিডিও ক্লাব থেকে তাঁর ছবির ক্যাসেট এনে বন্ধুরা ব্যবচ্ছেদ করি। রাজু আহমেদ ছিলেন স্মার্ট ও গুড লুকিং। তাঁর টুইস্ট ছিল, ভয়ংকর দৃষ্টিতে মিষ্টি হাসি আর চোস্ত অভিনয়। তাতেই বাজিমাত। দুঃখজনক ঘটনা, বাস্তবে তিনি এই শহরেই খুন হয়েছিলেন। প্রেমঘটিত। সমাজের ভিলেনদের হাতে।

আমাদের মুভি ক্যারেক্টারগুলো হলিউড-বলিউডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই হয়েছে। খেলাধুলার মতো মুভিতেও উন্নতদের ছোঁয়া থাকে। ঢাকাই মুভিতে কাহিনি অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ভিলেন এসেছে।

‘মাইল্ড’ ও ‘টাফ’ ভিলেনদের বেশি দেখা গেছে গত শতকের আশির দশকের আগ পর্যন্ত। এরা মূলত ছিল সম্পদ ও নারী লোভী। কুটনা টাইপ। অভিজাত শ্রেণির। বিশাল অনুগত বাহিনী বা গ্যাং ছিল না। কারণ, বড়সড় জায়গা বা সম্পদ লুণ্ঠনে যেতে হয়নি তাদের। ব্যক্তিগত রেষারেষিতেই ভিলেন সীমাবদ্ধ ছিল। আক্রমণে কখনো কখনো কেবল ছুরি-পিস্তল বের করেছে। পরে নায়কের সঙ্গে ঢিসুম ঢুসুম মার্কা ফাইটে হেরে ভেগেছে, না হয় কোর্ট-আদালত হয়ে জেলে ঢুকেছে। মানুষ হাফ ছেড়ে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে এসেছে।

সত্তরের দশকে আমাদের নতুন স্বাধীন দেশের চলচ্চিত্রে ভিলেন বা খলনায়কেরা তেমন হাইলাইটেড হননি। কিন্তু নজর কেড়েছিলেন খলনায়ক রাজু আহমেদ, তরুণ জসিম, শক্তিমান অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা, যিনি জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার বাবা এবং আরেক শক্তিমান অভিনেতা খলিলউল্লাহ খান। মজার ব্যাপার, গোলাম মুস্তাফা ও খলিলউল্লাহ খান দুজনই সুদর্শন ছিলেন, প্রথমে নায়ক ছিলেন, পরে ভিলেন হয়েছেন। তাঁরা দর্শকের কাছে মুস্তাফা ও খলিল নামে জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে জসিম সবচেয়ে বেশি মারপিট করতেন, মারদাঙ্গা ছিলেন। কাহিনির প্রয়োজনে তাঁকে আমৃত্যু দুর্ধর্ষ মারপিট করতে হয়েছে। মুস্তাফা আর খলিল ছিলেন সবচেয়ে অভিজাত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভিলেন। তাঁরা ঠান্ডা মাথায় কুট বুদ্ধি আঁটতেন। মুখে মিষ্টি হাসি, অন্তরে বিষের বাঁশি। হাতাহাতির মধ্যেই তাঁদের মারপিট সীমাবদ্ধ ছিল। অনেকে এই মাইল্ড ভিলেনদের উদয়ে ওপার বাংলার ছবির প্রভাবকে কিছুটা কারণ হিসেবে দেখেছেন। কারণ ভিলেনরা সামাজিক কুটচালেই ব্যস্ত ছিলেন। তখনো আমেরিকান বা পশ্চিমা ধাঁচের ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ গোলাগুলি ঢাকার মুভিতে এসে ঢোকেনি।

‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ ভিলেনদের উদয় হয় এর পরপরই। হলিউড থেকে বলিউড, বলিউড থেকে ঢালিউড—এই রোডম্যাপ ধরে ঢাকাইয়া মুভিতে আসে ধুম ধারাক্কা সংঘর্ষ। ভিলেনরা ভয়ংকর, দুর্ধর্ষ ও দর্শকপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই সময়ে দেশের মুভির কাহিনিতে অস্ত্রের ঝনঝনানি, হরেক কুকর্ম ও লোকেশন বৈচিত্র্যের সুযোগ পায় ভিলেনরা। মুভিতে প্রচুর টাকার লগ্নি খলনায়কদের এই ফুটে ওঠায় সহায়তা করে। এর সঙ্গে যোগ হয় পুরোনো ঢাকার ভিসিআর শো। মানুষ মুম্বাই ফিল্মের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। পরিচিত হয় আমজাদ খান নামের এক দুর্ধর্ষ মুম্বাই খলনায়কের সঙ্গে। ভয়ংকর অভিনেতা আমজাদ খান। একাই কাঁপায় ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান! তার সবচেয়ে বড় ঝাঁকুনিটি ছিল ‘শোলে’ মুভিতে গাব্বার সিংয়ের চরিত্রে। কথিত আছে, ‘শোলে’র থিম নেওয়া হয়েছিল হলিউড ওয়েস্টার্ন মুভি ‘বুচ ক্যাসিডি অ্যান্ড দ্য সানড্যান্স কিড’ থেকে। আর শোলের হুবহু আদলে বাংলাদেশে হয় ‘দোস্ত দুশমন’। গাব্বার সিংয়ের জায়গায় উদয় হন গাফফার খান জসিম! যাঁরা দুই মুভিই দেখেছেন, তাঁদের মতে গাব্বার সিং আমজাদ খানের চেয়ে গাফফার খান জসিম বেশি চোখা অভিনয় করেছেন।

জসিম ছিলেন মারদাঙ্গা ভিলেন। নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে ‘রংবাজ’ ছবি থেকেই মূলত তাঁর যাত্রা শুরু। ভিলেন হিসেবে ছিলেন ক্যারিশমাটিক। শুধু যে ভিলেনেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন তা না, নিজ বন্ধুদের নিয়ে ফাইট ডিরেকশনের গ্রুপ ‘জ্যাম্বস গ্রুপ’ করেছিলেন। প্রত্যেকের নামের আদ্যাক্ষরেই ‘জ্যাম্বস’। মুম্বাইয়ের আমজাদ খান যেমন, ঢাকার জসিম তেমন—একচেটিয়া মার্কেট! ভালো ঘোড়া ও রিভলবার চালাতেন। ফলে পোশাকি আর ওয়েস্টার্ন কাউবয় মার্কা মুভিতে জসিমের ডিমান্ড ছিল খুব।

পোশাকি বা রাজকীয় ছবিতে আরেক সিনিয়র ভিলেন ছিলেন রাজ। সত্তর দশক থেকেই রাজকীয় ছবিতে রাজ ছিলেন জনপ্রিয়। মুম্বাইয়ের তালেই যেন আমাদের ভিলেনরা প্রতিফলিত হয়েছিলেন। নইলে অমরেশ পুরির ঢঙে কেন রাজীব উদয় হবেন? ওয়াসিমুল বারী রাজীব। অভিনয়ের জীবদ্দশায় তিনি শাসন করেছেন ভিলেন সাম্রাজ্য। মিশা সওদাগর, মিজু আহমেদরা ভিলেন হিসেবে ঢাকাই মুভিতে প্রথম সারিতে থাকলেও জসিম-রাজীবদের জনপ্রিয়তা অনেকটা মেসি-নেইমারের মতো ছিল। ভিলেন জসিম ঢাকার আমজাদ খান হিসেবে শাসন করতে করতে একসময় হঠাৎ শত্রুঘ্ন সিনহা স্টাইলে নায়কের ভূমিকায় এসেছিলেন। কিন্তু আপামর দর্শক নায়ক জসিমের চেয়ে ভিলেন জসিমকে কাছে টেনেছিল বেশি।

ভিলেন মানেই শুধু মারামারি না। ভিলেন মানে একটা জ্বলজ্বলে চরিত্র, যার মধ্যে থাকবে সূক্ষ্ম উন্নত কুশলী অভিনয়। কিন্তু ঢাকাই মুভি যত কমার্শিয়াল হতে থাকে, ভিলেনের অভিনয়ের বিষয়টা সূক্ষ্ম থেকে স্থূল হয়। অভিনয়ের জায়গায় ভীষণ দর্শন আর মারপিটের যোগ্যতা নিয়ে উদয় হলেন জাম্বু নামের এক ভিলেন। জাম্বুর মাথা ন্যাড়া, ফিগার পাহাড়ের মতো। যেন হেভিওয়েট বক্সার। জনপ্রিয়ও হলেন এক শ্রেণির দর্শকের কাছে।

কলেজবন্ধুরা বসে আড্ডা দিচ্ছি আজিমপুরে রাস্তার ধারের চা স্টলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মার্কা এক রংচটা জিপে মাথায় কাউবয় হ্যাটে দলবল নিয়ে যাচ্ছেন জাম্বু। এক বন্ধু হঠাৎ উত্তেজনায় ডাক দিয়ে বসল, ‘অই জাম্বুরা!’ ঘ্যাঁচ করে জিপ থামল। ব্যাকে আসতে লাগলে। আমরা স্থানীয়। বসে থাকলাম। জাম্বু নামলেন। কাউবয় স্টাইলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ক্যা গালি দিছ্যা?’ আমরাও ঠান্ডা মাথায় আকাশের দিকে তাকিয়ে কাউবয় স্টাইলে উত্তর দিলাম, ‘কইবার পারি না।’ দূর থেকে এগিয়ে এলেন কয়েকজন সিনিয়র ভাই। একজন বললেন, ‘কী অইছে?’ জাম্বু বললেন, ‘আমারে কোন পিচ্চি জানি জাম্বুরা কইয়া গালি মারছ্যা!’ সিনিয়র ভাই বললেন, ‘আপনে পপুলার ভিলেন। আপনারে ভক্তরা জাম্বুরা-আপেল-নাশপাতি যা মনে কয় ডাকব, আপনে রাগেন ক্যান? অইটা গালি না, বুলি!’ ওরা বুঝলেন, এরা স্থানীয়। সবার সঙ্গে হ্যান্ডশেক আর কোলাকুলি করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জিপে উঠে চলে গেলেন ‘জাম্বু’রা।

‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ ভিলেনের সঙ্গে কমেডি যোগ করে নজরে আসেন মুম্বাইয়ের কাদের খান। আমজাদ খানের সঙ্গেও কমেডিটা মানিয়ে যায়। বিষয়টা বুঝতে আমরা ‘হিম্মতওয়ালা’ ছবিতে শ্রীদেবী ও জিতেন্দ্রর ‘বাহা বাহা বাহা খেল শুরু হো গায়া’ গানের প্রেক্ষাপট ভাবতে পারি। জমিদার আমজাদ খানের একমাত্র মেয়ে শ্রীদেবীর সঙ্গে সাধারণ প্রজার ছেলে জিতেন্দ্রর প্রেম। সেটা কোনোভাবেই মানছেন না আমজাদ খান। ক্লাস-বৈষম্য। এদিকে শ্রীদেবী দুর্ঘটনাক্রমে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। মাথায় বাজ পড়ে আমজাদ খানের! এলাকায় তাঁর খানদান আর জমিদারি মিশে যাবে ধুলায়। তিনি আদর করে জিতেন্দ্রকে ডেকে পাঠান। জিতেন্দ্র এলে তাঁকে ‘জামাই জামাই’ বলে ডাকা শুরু করেন। যে জিতেন্দ্রকে মারার জন্য প্রস্তুত ছিলেন আমজাদ, তাঁকেই অনুরোধ করেন মেয়েকে বিয়ে করতে। বিষয়টি ডুপ্লেক্স বাড়ির দোতলা থেকে দেখে ভীষণ আনন্দ পায় কিশোরী শ্রীদেবী। জিতেন্দ্র আমজাদ খানকে বলে, সে মাকে জিজ্ঞেস করে আসতে চায়। জবাবে কাতরভাবে আমজাদ খান বলেন, ‘কই আমার মেয়েকে মা বানানোর সময় তো মাকে জিজ্ঞেস করোনি?’

পরের দৃশ্যটি আরও মজার। দোতলায় জিতেন্দ্র আর শ্রীদেবী ‘বাহা বাহা বাহা খেল শুরু হো গায়া’ গানের তালে নাচছে, নিচতলায় আমজাদ খান তা শুনে শুনে উপভোগ করছেন। তাঁর জমিদারি রক্ষাই এখন মুখ্য।

ঢাকাই মুভিতে কমেডি ও ভিলেন চরিত্রের সফল সমন্বয় ঘটান এ টি এম শামসুজ্জামান। মূলত ‘কুটনা ভিলেন’ চরিত্রটি তাঁর দখলে থাকলেও এর সঙ্গে কমেডিও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেন তিনি। এই সেদিনও এক ভুল সংবাদে তাঁর মৃত্যু ঘটে গিয়েছিল প্রায়। এর প্রতিবাদে এক তীব্র প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, এর আগেও কয়েকবার তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। তিনি অনুরোধ করেন, তাঁকে মারার আগে যেন ফোনে একবার জিজ্ঞেস করে নেওয়া হয়। তাঁর ফোন নম্বরও দিয়ে দেন তিনি!

নায়ক থেকে খলনায়ক বনে যান ঢাকার কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। তাঁর খল চরিত্রেও কমেডি ছিল কিংবদন্তির মতো। মুম্বাইয়ের কাদের খানের মতোই কমেডিতে সফল ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। শুধু মুভিতে না, টিভিতে তাঁর ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্র এখনো সূর্যের মতো জ্বলজ্বল।

কান কাটার কথা যখন এলই, কান কাটার এক সত্য ঘটনা দিয়ে শেষ করি। জাপানে দম্পতিদের এক চুমু প্রতিযোগিতায় দীর্ঘক্ষণ চুমু দিয়ে এক দম্পতি চ্যাম্পিয়ন হয়। কিন্তু এই খেলা চলাকালে বেচারা স্বামী তার এক কান হারান, যা পরে আর জোড়া লাগানো যায়নি। তবে কান হারিয়ে ছেলেটি ‘কান কাটা খলনায়ক’ না হয়ে ‘কান কাটা নায়ক’ বনে গেছেন।

কান শুধু খলনায়কদেরই কাটে না, কখনো কখনো নায়কদেরও কাটে।