মুঠোফোনের গল্প

>সবার মতো তারকাদেরও মুঠোফোন নিত্যসঙ্গী। এই যন্ত্রসঙ্গীকে নিয়ে গল্পের কমতি নেই। কখনো হারিয়ে গেছে প্রিয় মুঠোফোন, কখনো প্রিয় মানুষ লুকিয়ে কল করে চমকে দিয়েছেন। এমন কিছু গল্প নিয়েই আমাদের এবারের ঈদের বিশেষ আয়োজন। বেশ কজন তারকা জানিয়েছেন তাঁদের মুঠোফোন নিয়ে কিছু ঘটনা। পাঠকদের জন্য তা-ই তুলে ধরেছেন হাবিবুল্লাহ সিদ্দিক

মা আর বোনদের মুঠোফোন কিনে দিয়েছেন চঞ্চল
২০০৫ সাল। আজকের অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী তখন নবাগত। মঞ্চে কাজ করলেও টেলিভিশনে দেখা যেত খুব কম। ওই বছরই মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয় করে তুমুল আলোচনায় আসেন তিনি। বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, শহর থেকে রাস্তা, ঘাট, নদী পেরিয়ে মায়ের জন্য মুঠোফোন নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ওই বিজ্ঞাপনের ঘটনা মনে করিয়ে দিতেই চঞ্চল বললেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি পাবনাতে যাওয়ার সময় ওভাবেই যাই। একেবারে গ্রামের মধ্যে আমাদের বাড়ি।’ বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়ার পর সত্যি সত্যি মায়ের জন্য মুঠোফোন কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন? চঞ্চল বললেন, ‘বিজ্ঞাপনটা যখন সবাই খুব পছন্দ করলেন, তখন আমার মাথায় একটা চিন্তা এল, শুধু মা কেন, পরিবারের সবাইকে আমি মুঠোফোন কিনে দেই। আমি তখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম। খুব অল্প টাকা বেতন পেতাম। মুঠোফোন তখন এখনকার মতো সস্তা ছিল না। তাই তিন-চার মাস ধরে টাকা জমিয়ে মা-বাবা এবং আমার পাঁচ বোনকে মুঠোফোন কিনে দিয়েছিলাম। ওটা পেয়ে তাঁদের আনন্দ ছিল দেখার মতো।’

এ তো পারিবারিক গল্প। বিজ্ঞাপনটি যখন নিয়মিত প্রচার হতো, তখন নানা ধরনের আবেগঘন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে চঞ্চল চৌধুরীকে। সেসব মনে করে চঞ্চল বলেন, ‘আমার জন্য ওই বিজ্ঞাপনটা সত্যি একটা আশীর্বাদ ছিল। অনেক মানুষ যেমন চিনেছে, তেমনি সবার আবেগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলাম আমি।’

যে কারণে ধরা খেয়েছিলেন আফরান নিশো
তখন সবে প্রেমিক হয়েছেন আফরান নিশো! তাঁর ভাষায় প্রেমের শুরুর সময়ের গল্প এটা। ২০০০ সালের ঘটনা। সে সময় মোবাইলফোন সেবাদাতা সেবা কোম্পানির সংযোগ নিয়েছিলেন। প্রতি মিনিটে প্রচুর বিল গুনতে হতো। ওই সময় একটা ‘অফার’ দিল কোম্পানি। ল্যান্ড লাইন থেকে মুঠোফোনে কল করলে প্রথম মিনিট ফ্রি। পরের মিনিট থেকে ইনকামিং চার্জ দিতে হবে। নিশো বললেন, ‘তখন আমার প্রেমিকা মানে বর্তমান বউয়ের বাবার বাসায় ল্যান্ডফোন ছিল। ও সেখান থেকে আমার মুঠোফোনে কল দিত। এক মিনিট হওয়ার আগেই কেটে দিত। একটু পর আবার। এভাবে সারা দিনই এক মিনিটের ফ্রি ইনকামিং সুবিধা নিয়ে আমরা প্রেম করতাম। প্রথম দিকে সময়টা মিলত না। এক মিনিট পার হয়ে এক বা দুই সেকেন্ড হয়ে যেত। পরে দুজন সময়ের মাপ বুঝে ফেলি। এক মিনিট হওয়ার আগেই টুক করে কেটে দিতাম লাইন।’

সময়ের হিসাব বুঝে ফেললে কী হবে। সমস্যা শুরু হয় অন্য জায়গায়। প্রতিদিন ল্যান্ডফোন থেকে মুঠোফোন কল করায় মাস শেষে লম্বা বিল এসে পড়ল। প্রেমিকার বাবা তো বিল নিয়ে চ্যালেঞ্জ করলেন টিঅ্যান্ডটি অফিসে। তারপর বিলের বিস্তারিত পেয়ে গেলেন হাতে। দেখলেন, ওই মাসে এক মুঠোফোন নম্বরে প্রতিদিন অসংখ্যবার কথা হয়েছে।

এবার বাবা চ্যালেঞ্জ করলেন মেয়েকে। মেয়ে কি আর সহজে স্বীকার করে! নিশো বললেন, ‘ওই সময় মুঠোফোনের দাম ছিল অনেক। চাইলেও ওকে মুঠোফোন কিনে দিতে পারছিলাম না। কিন্তু এমন একটা বিব্রতকর ঘটনা ঘটবে, সেটাও আশা করিনি। তারপর আর কী হবে। সবকিছু তো মেনেই নিলেন। মেনে নিয়েছেন বলেই তো ও এখন আমার স্ত্রী এবং আমার সন্তানের মা।’

থাইল্যান্ডে মুঠোফোন হারিয়েছিলেন শবনম
গত বছরের ঘটনা। থাইল্যান্ডে শুটিং করতে গিয়েছিলেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। প্রথমবার বিদেশভ্রমণ। তা-ও আবার একা। একা বলতে পুরো ইউনিট যাওয়ার দুই দিন আগেই গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, নিজের মতো ঘোরাঘুরি ও কেনাকাটা। কিন্তু এর মধ্যে ঘটল এক দুর্ঘটনা। সেই স্মৃতি মনে করে শবনম বললেন, ‘প্রথম দিন ভালোয় ভালোয় পার করলাম। পরদিন কেনাকাটা শেষ করে হোটেলে ফিরছিলাম। আমার হোটেলটা ছিল একেবারে বড় রাস্তার সঙ্গে লাগানো। হোটেলের ভেতরে ট্যাক্সি ঢুকতে দেওয়া হয় না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাড়া দিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। তারপরই বুঝলাম ঘটনা ঘটে গেছে।’

কী সেই ঘটনা? সেদিন হোটেলের অভ্যর্থনাকারীদের সঙ্গে কথা বলে রুমের ভেতরে গিয়ে দেখেন মুঠোফোনটা নেই! দৌড়ে আবার অভ্যর্থনাকক্ষে চলে আসেন। জানতে চান, মুঠোফোনটা রেখে গেছেন কি না। না, সেখানেও নেই। দৌড়ে রাস্তায় আসতে আসতে দেখেন ট্যাক্সি নেই। এখন উপায়? দেশেও যোগাযোগ করতে পারছেন না, থাইল্যান্ডে থাকা এক বন্ধুর সঙ্গেও যোগাযোগ করার সুযোগ নেই। ফারিয়া বললেন, ‘ফেসবুকে ঢুকে যে জানাব, সে উপায়ও নেই। কারণ, ওই ফোন থেকেই আমার ফেসবুকে লগইন করা ছিল। ভাগ্য ভালো আমি আমার বাবার ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড জানতাম। সেটাতে ঢুকে ফুফাতো বোনকে জানালাম। ফুফাতো বোন জানিয়েছে আমার আরেকটা বন্ধু প্রিয়তাকে। প্রিয়তা জানিয়েছে প্রভা আপুকে। প্রভা আপু জানিয়েছেন জোভানকে। পরদিন শুটিং ইউনিটের ওই দলের সঙ্গে জোভানও যাবে থাইল্যান্ড। সেদিন রাত দুইটায় আমার আম্মু জোভানকে আমার বাসা থেকে আরেকটা ফোন দিয়েছে। সেটা দিয়েই সেবার থাইল্যান্ডে শুটিং শেষ করেছি। হারিয়ে যাওয়া ফোনটা আর পাওয়া যায়নি।’

মেহ্জাবীনের নির্বাক মুঠোফোন
২০০৫ সাল থেকে মুঠোফোন ব্যবহার করেন অভিনেত্রী মেহ্জাবীন চৌধুরী। লোকে মুঠোফোন কিনেই সুন্দর সুন্দর রিংটোন সেট করেন। কিন্তু মেহ্জাবীন মুঠোফোন কিনে রিংটোন দিয়ে রাখেন ‘সাইলেন্ট মোডে’। সেই যে বন্ধ করেছেন আর কখনোই তাঁর মুঠোফোনে রিংটোন বাজেনি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মুঠোফোন বদলেছেন কিন্তু রিংটোন দেওয়ার বেলায় কোনো আপস নেই। মেহ্‌জাবীন বললেন, ‘আমার রিংটোনের ফোবিয়া আছে। ফোন বেজে উঠলে খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। এ কারণে সব সময় বন্ধ রাখি ফোনের আওয়াজ। এমনকি আমার ফোনে ভাইব্রেশনও দেওয়া থাকে না।’ তাহলে ফোন এলে? মেহ্‌জাবীন বললেন, ‘যদি চোখের সামনে দেখি কেউ কল দিয়েছেন, তাহলে রিসিভ করি। আর যদি না দেখি, তাহলে পরে তাঁকে কল ব্যাক করে বকা খাই। ২০০৫ সাল থেকেই এমনটা হয়ে আসছে। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি।’

ফোন হারিয়ে মন খারাপ ছিল পিয়ার
তখন খুলনাবাসী জান্নাতুল পিয়া। ক্লাস এইটে পড়ার সময়ই নকিয়া সেট দিয়ে মুঠোফোন ব্যবহার শুরু করেছিলেন। সেটা ছিল ছোট্ট একটা ফোন। মামা দেশের বাইরে থেকে পাঠিয়েছিলেন। বললেন, ‘আমি তো দারুণ খুশি। ওই বয়সে নিজের মুঠোফোন। এটা কম কথা নয়। এসএসসি পাস করে আবার একটা নতুন ফোন কিনি এবং ঢাকায় চলে আসি।’

তবে প্রথম ফোন মামা উপহার দিলেও পরে নিজেও ফোন কিনেছেন। নিজের হাত খরচের টাকা জমিয়ে। পিয়ার খুব আফসোস ওই সময় ফোন উপহার দেওয়ার কেউ ছিল না। তবুও টাকা জমিয়ে একটা আইফোন কিনেছিলেন বিয়ের আগেই। ফোন উপহারের দুঃখ ঘুচে গেছে বিয়ের পর। বিয়ের বছরখানেকের মধ্যে স্বামীর কাছ থেকে নতুন একটা আইফোন উপহার পেয়েছেন তিনি। এখন নিয়মিতই উপহার পান। উপহারের আনন্দ যেমন আছে, তেমনি ফোন নিয়ে দুঃখও আছে পিয়ার। একবার উত্তরায় একটা ফ্যাশন শোতে মডেল হয়েছিলেন। শো শেষ করে দেখেন, দুটো মুঠোফোন হাওয়া। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বললেন, ‘ওই দিন খুব খারাপ লেগেছিল আমার। এভাবে দুটো ফোন একটা শো করতে এসে হারিয়ে ফেলব একদম ভাবিনি।’

কথা শেষ করার আগে জানালেন, নিজে শুধু মুঠোফোন উপহার পেয়েছেন এমন নয়, দিয়েছেনও। কিছুদিন আগে ছোট ভাই মাহবুবকে ফোন দিয়েছেন। দেখেছেন প্রিয় ভাইয়ের আনন্দ। উপহার পাওয়ার মতো দেওয়ার আনন্দও আছে। সেটা যদি মুঠোফোন হয়, তাহলে তো কথাই নেই।