লোকে লোকারণ্য লোকার্নো

লোকার্নো উৎসবের প্রাণকেন্দ্র পিয়াৎজা গ্রান্দা। ছবি: সংগৃহীত
লোকার্নো উৎসবের প্রাণকেন্দ্র পিয়াৎজা গ্রান্দা। ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ সুইজারল্যান্ডের পর্যটন শহর লোকার্নো। এই শহর বিশ্বজুড়ে মূলত পরিচিত এখানকার চলচ্চিত্র উৎসবের সুবাদে। ওপেন ডোর্স কার্যক্রমের আওতায় এবার বাংলাদেশের একঝাঁক তরুণ নির্মাতা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে। ১৩ আগস্ট শেষ হওয়া এই উৎসবে ছিল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের উল্লেখযোগ্য ছবির প্রদর্শনীও। ইউরোপের প্রথম সারির এ উৎসবে কেমন ছিল আমাদের তরুণ নির্মাতাদের অভিজ্ঞতা?

নির্মাতা কামারআহমাদসাইমনলিখেছেন বিস্তারিত।

প্রথম দিনের উৎসব অভিজ্ঞতা

বেলা দেড়টায় প্রদর্শনী, সোয়া একটা বাজে…গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছি ফেস্টিভ্যাল অফিসের বাইরের রাস্তায়, চালকের কোনো খবর নেই! লোকার্নোতে ‘ওপেন ডোর্স স্ক্রিনিং’য়ের উদ্বোধনী ছবি শুনতে কি পাও! ওপেন ডোর্সের প্রধান সোফি বার্দো উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন মোবাইলে লোকার্নোর আর্টিস্টিক ডিরেক্টর কার্লোস শারটিয়ানের সঙ্গে, তিনি ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছেন লা’আলট্রাসালায় (ওপেন ডোর্সের প্রদর্শনীর ছবিঘরে)। এর মধ্যে চলে এল গাড়ি, ছবি শুরুর ঠিক তিন মিনিট আগে পৌঁছালাম ভেন্যুতে। সাদরে স্টেজে ডেকে নিলেন কার্লোস। সামনে তাকিয়ে দেখি উৎসব শুরুর প্রথম দিনে এই ভরদুপুরে হলভর্তি দর্শক। এর আগে বার্লিন গিয়েছি ট্যালেন্ট ক্যাম্পাসের সম্পাদনা ল্যাবে শুনতে কি পাও! নিয়ে, কানে নিমন্ত্রিত ১০ তরুণ নির্মাতার সঙ্গে হেঁটেছি লালগালিচায় শঙ্খধ্বনি চিত্রনাট্যের জন্য; কিন্তু সুইজারল্যান্ডের লোকার্নোতে এসে বুঝলাম একে কেন ‘ফেস্টিভ্যাল ফর ফিল্মমেকার্স’ বলা হয়।

দক্ষিণ সুইজারল্যান্ডের পর্যটন শহর লোকার্নো
দক্ষিণ সুইজারল্যান্ডের পর্যটন শহর লোকার্নো

লোকার্নোতেই ছিলেন…

আল্পস পাহাড়ের পাদদেশে ম্যাগিউর নামে নীল স্বচ্ছ জলের এক অপরূপ লেক আছে, সেই লেকের উত্তর-পূর্বে ঢুকে গেছে ম্যাগি নদী। এই নদীর উত্তর পাড়ে লোকার্নো আর দক্ষিণ পাড়ে অবকাশ-ভূস্বর্গ আসকোনা গ্রাম। আমরা ছিলাম সেই আসকোনায় ক্রিস্টোফোরো নামে এক বিশেষ হোটেলে। বিশেষ হোটেল বলছি এই কারণে যে, এখানে কোনো ইন্টারনেট বা টেলিভিশন নেই…প্রকৃতির মাঝখানে নিরবচ্ছিন্ন সময় কাটানোর কঠিন ব্যবস্থা। তাতে অবশ্য অসুবিধা নেই, হোটেল থেকে গাড়িতে লোকার্নো ১০ মিনিটের রাস্তা। আমাদের জন্য সকাল-বিকেল গাড়ি ছাড়াও প্রতি ৪০ মিনিট পরপর ছিল লোকার্নোর বিশেষ বাস, তাই সন্ধ্যা পর্যন্ত লোকার্নোতেই থাকা হতো। কিন্তু প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হোটেলের জানালায় ঝুলে থাকা পোস্টকার্ডের মতো লেকটাকে দেখে মনে হতো, শুধু এর দিকে তাকিয়েই একটা জীবন পার করে দেওয়া যায়।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর (ডানে) টেলিভিশন প্রদর্শিত হয়েছে ওপেন ডোর্স স্ক্রিনিং বিভাগে
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর (ডানে) টেলিভিশন প্রদর্শিত হয়েছে ওপেন ডোর্স স্ক্রিনিং বিভাগে


বাংলাদেশ
থেকে আরও ছিলেন…

হ্যাঁ, বাংলাদেশ থেকে মোটামুটি একটা বড় দলই ছিল। মূল প্রতিযোগিতায় ওপেন ডোর্সে আমার ডে আফটার টুমরো ছাড়াও ছিল ইশতিয়াক জিকোর সিনেমা সিটি অ্যান্ড ক্যাটস। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশ থেকে প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত আটটি চিত্রনাট্যের মধ্যে ছিল এই দুইটা। এর বাইরে ওপেন ডোর্স ল্যাবের প্রযোজক কর্মশালায় ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশের মোট আট প্রযোজক-নির্মাতা। সেখানে আদনান ইমতিয়াজ, আবু শাহেদ ইমন ও রুবাইয়াৎ হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের। ওপেন ডোর্স স্ক্রিনিং আবার ছিল এই চার দেশেরই ২১টা ছবি, যেখানে আমার শুনতে কি পাও! ছাড়া বাংলাদেশ থেকে ছিল রুবাইয়াৎ হোসেনের আন্ডার কনস্ট্রাকশন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর টেলিভিশনসহ আরও তিনটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি। মজার ব্যাপার হলো ঢাকায় একে অন্যের সঙ্গে তেমন একটা দেখা না হলেও, লোকার্নোতে আমরা কিন্তু সব দল বেঁধে ঘুরতাম।

বাঁ থেকে আদনান ​ইমতিয়াজ, কামার আহমাদ সাইমন, সারা আফরীন, রুবাইয়াৎ হোসেন, ইশতিয়াক জিকো (পেছনে) এবং আবু শাহেদ (ইমন)
বাঁ থেকে আদনান ​ইমতিয়াজ, কামার আহমাদ সাইমন, সারা আফরীন, রুবাইয়াৎ হোসেন, ইশতিয়াক জিকো (পেছনে) এবং আবু শাহেদ (ইমন)

রুবাইয়াতের সেই খিচুড়ি…
লোকার্নোতে নামার পর থেকে ইমনের সঙ্গে দেখা হলেই বলে, ‘ভাই বুঝলেন, ভাত খাওয়া দরকার’…ফারুকী দেখা হলে মজা করে বলেন, ‘…বুঝলা না, আমরা তো হইলাম গিয়া রাইসিস্ট!’ এর মধ্যে বেনিঞ্জোলার মেয়র একদিন তাঁদের সিটি হলে আমাদের দাওয়াত দিলেন…এক টেবিল ভর্তি নানান পদের ছোট ছোট বাটি, কোনোটা পনিরের, তো কোনোটা চিংড়ি মাছের, কোনোটা আবার শুধুই সালাদ…এর মধ্য থেকে কেউ একটা বাটি খুঁজে বের করল, যেটায় এক চিমটি খিচুড়ির মতো সালাদ। তো সবাই সেই খিচুড়ির সালাদ-বাটি খুঁজে বের করে খাওয়া শুরু করল। এর মধ্যে রুবাইয়াৎ শুনলাম এক স্যুটকেস ভর্তি ঘি, মসলাপাতি আর একটা রাইসকুকার নিয়ে এসেছেন নিজে রান্না করে খাবেন বলে। একদিন রাত্রে প্রায় ১২টা বাজে, পেঁয়াজ শেষ…ইমন আর রুবাইয়াৎ দোকানে দোকানে পেঁয়াজ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। শেষে পেঁয়াজ ছাড়াই সবাই রওনা দিলাম রুবাইয়াতের হোটেলে…রাইসকুকারে রান্না হলো খিচুড়ি! রুবাইয়াৎ গুণী নির্মাতা জানতাম, কিন্তু এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে রাত তিনটায় আসকোনা নামের অজানা এক ইউরোপীয় গ্রামের হোটেল-ঘরে রাইসকুকারে তার রান্না করা পেঁয়াজ ছাড়া সেই খিচুড়ির গন্ধে মুখে পানি চলে এল। রুবাইয়াতের আরেকটা পরিচয় পেলাম। নবীনতম সদস্য আদনান থেকে শুরু করে জিকো, ইমন, সারা (শুনতে কি পাও! এবং ডে আফটার টুমরোর প্রযোজক সারা আফরীন) এমনকি ফারুকী পর্যন্ত সবাই আঙুল চেটে খেলেন সেই ঘিয়ের মাতাল করা সুবাসের খিচুড়ি।

লোকার্নোর ওপেন ডোর্স তো তিন বছর…
হ্যাঁ, মূল প্রতিযোগিতার জায়গা যে হাব, সেখানে আরও দুই বছর সুযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশ, কিন্তু ওপেন ডোর্সের স্ক্রিনিং বা ল্যাবে আগামী দুই বছরে বাংলাদেশ না-ও থাকতে পারে। তবে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আয়োজকদের কাছ থেকে যেটুকু জেনেছি এই বছর আটটা দেশ থেকে হাবের জন্য চিত্রনাট্য জমা পড়েছিল ৫৫০-এর বেশি, যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই নাকি ছিল ১০০-এর অনেক ওপরে। তাই এই তিন বছরের সুযোগ তখনই কাজে লাগবে, যখন আমাদের নির্মাতারা লোকার্নোর মতো একটা প্রথম সারির আন্তর্জাতিক উৎসবের দাবির বিষয়টা মাথায় রাখবেন।

পিয়াৎজা গ্রান্দার পুরস্কার মঞ্চে কামার আহমাদ সাইমন (মাঝে‍)। ছবি: সংগৃহীত
পিয়াৎজা গ্রান্দার পুরস্কার মঞ্চে কামার আহমাদ সাইমন (মাঝে‍)। ছবি: সংগৃহীত

পিয়াৎজা গ্রান্দার সেই রাত…

পিয়াৎজা গ্রান্দা! বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ মঞ্চ। এর অনুভূতি বোঝানো কঠিন। এটা তো শুধু স্বীকৃতি না, তার চেয়েও বেশি কিছু আছে এখানে। লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবের প্রাণকেন্দ্রই পিয়াৎজা গ্রান্দা। বেলা তার, আলেকজান্ডার সুখোরভ, ফাতিহ আকিন, আব্বাস কিয়ারোস্তামির মতো মরমি পরিচালকের বিশ্ব অভিষেকই হয়েছে এই পিয়াৎজা গ্রান্দার মঞ্চে! প্রতি রাতে এখানে বসে প্রায় ৮ হাজার দর্শকের আসর, মঞ্চের পেছনে থাকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ (৮৫ x ৪৫ ফুটের) উন্মুক্ত-প্রদর্শনী-পর্দা। প্লাজার চারপাশের ভবনগুলোর গায়ে চলতে থাকে মঞ্চে দাঁড়ানো মানুষের রেফারাল ছবির প্রক্ষেপণ। লালগালিচায় দাঁড়িয়ে আছি, মঞ্চে দেখলাম আবার সেই কার্লোস শারটিয়ান… লোকার্নোর আর্টিস্টিক ডিরেক্টর! ওপেন ডোর্স হাবের শ্রেষ্ঠ প্রজেক্টের জন্য নাম ঘোষণা হলো ডে আফটার টুমরো সার​িথ প্রযোজক সারা আফরীনকে নিয়ে উঠলাম পিয়াৎজা গ্রান্দার মঞ্চে। চারপাশের আলোর দ্যুতি, সামনে হাজারো দর্শকের মুখ…কিন্তু আবেগে আমার কাঁধটা ভার ভার, মাথায় বোধ করলাম কিছুটা চাপ…মনে মনে বললাম, ‘ছবিটা বানাতে হবে।’