মাটির নিচে শিশুদের খেলাঘর!

আবদুল আজিজের মতো দুই শতাধিক সিরিয়ান শিশু ‘ল্যান্ড অব চাইল্ডহুড’-এ প্রতিদিন খেলতে আসে। ছবি: ইউনিসেফের সৌজন্য
আবদুল আজিজের মতো দুই শতাধিক সিরিয়ান শিশু ‘ল্যান্ড অব চাইল্ডহুড’-এ প্রতিদিন খেলতে আসে। ছবি: ইউনিসেফের সৌজন্য

রক্ত ও ধুলো মাখা অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সের আসনে বসা ওমরান দাকনিশ কিংবা সাগর তীরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা শিশু আয়লান কুর্দির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। ছবিগুলো বিশ্ববিবেককে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। ছয় বছরের মার্কিন শিশু অ্যালেক্স ওমরানকে নিজ বাড়িতে জায়গা দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে চিঠিও লিখেছিল। ওমরান-আয়লানদের মতো আর যেন কাউকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে না হয় সে জন্য সিরিয়ায় শিশুদের নিরাপদে খেলাধুলার ব্যবস্থা করতেই মাটির খুঁড়ে ভূগর্ভস্থ মাঠ বানানো হয়েছে।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ায় আলেপ্পোর কথা এখন বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনাম। অভিযানের কারণে হাজারো মানুষ আলেপ্পো ছেড়ে পালাচ্ছে। এ দৃশ্য শুধু আলেপ্পো নয় প্রায় পুরো দেশটিরই। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে শিশু শৈশব, মানুষের পারিবারিক জীবন কিংবা শেষ জীবন আয়েশে কাটানোর সময়ও নেই। কখন কোথায় হামলা হয় কেউ জানে না। বেঁচে থাকাই বড় কথা। যারা পারছে ইউরোপ কিংবা অন্য কোথায় পালাচ্ছে। আর যাদের সে সুযোগ নেই তারা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে সময় পার করছে।

সাত বছরের মাসার মতো অন্য শিশুরাও সেখানে নিরাপদে খেলতে পারে। ছবি: ইউনিসেফের সৌজন্য
সাত বছরের মাসার মতো অন্য শিশুরাও সেখানে নিরাপদে খেলতে পারে। ছবি: ইউনিসেফের সৌজন্য

ইনডিপেনডেন্টের খবরে বলা হয়েছে, এরই মধ্যে দেশটির শিশুরা শৈশবে খেলা করার মতো নিরাপদ জায়গা পেয়ে নিজেদের মতো করে বেড়ে উঠছে। মাটির নিচেই তারা বাংকারের মতো জায়গায় খেলাধুলা করছে। সিরিয়ায় গত পাঁচ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীরা এ অবস্থার জন্য একে অপরকে দুষছে। চারদিকে বোমা হামলা, খাবারের সংকট এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীর অভাবে চরম ভোগান্তিতে রয়েছে দেশটির বাসিন্দারা। স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগের সাবেক কয়েকজন ছাত্রের নেতৃত্বে শিশুদের খেলার জন্য মাটির নিচে নিরাপদ একটি জায়গা বানানো হয়েছে। সহিংসতার মধ্যে শিশুদের স্বাভাবিক শৈশব দিতে কাজ করার চেষ্টা করছে কিছু তরুণ। সেখানে নিরাপত্তার মধ্যে শিশুরা খেলাধুলা করতে পারে। খেলনা গাড়ি, নাগরদোলা, খেলার জন্য ছোট ছোট ঘর, খেলনা ঘোড়াসহ অনেক কিছুই আছে সেখানে। মাটি খনন করে বানানো ওই খেলাঘরে খেলনা গাড়ি থেকে শুরু করে শিশুদের জন্য অনেক আয়োজনই আছে। পার্কের মতো বানানো ওই খেলাঘরে শিশুরা আপন মনেই খেলা করে। দু মাসের কঠোর পরিশ্রমের ফল শিশুদের এই খেলাঘরটিকে বলা হচ্ছে ‘ল্যান্ড অব চাইল্ডহুড’।

‘ল্যান্ড অব চাইল্ডহুড’-এ আছে শিশুদের জন্য খেলনা গাড়িও। ছবি: ইউনিসেফের সৌজন্য
‘ল্যান্ড অব চাইল্ডহুড’-এ আছে শিশুদের জন্য খেলনা গাড়িও। ছবি: ইউনিসেফের সৌজন্য

১০ বছর বয়সী শিশু আবদুল আজিজ বলেছে, ‘আমার মা প্রতিবেশী শিশুদের সঙ্গে বাইরে খেলতে দিতে চান না। কিন্তু যখন তিনি শুনলেন যে আমরা মাটির নিচে খেলি। এরপর আমাকে আর বাইরে খেলতে দিতে আপত্তি করেননি।’ সে তার বন্ধুদের সঙ্গে মাটির ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের মাঠে খেলে। সিরিয়ার সরকারি বাহিনী এবং বিদ্রোহীদের ছোড়া গোলাবর্ষণ থেকে তারা সেখানে নিরাপদেই খেলাধুলা করে। আবদুল আজিজের বাবাকে যুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে।

এমন ব্যবস্থা থাকলে ওমরান দাকনিশ ও আয়লান কুর্দির ছবি হয়তোবা বিশ্ববাসীকে দেখতে বোধ হয় হতো না। এ ক্ষেত্রে আবদুল আজিজরা মনে হয় একটু ভাগ্যবানই।

মাটির নিচে বাইরের জগতের মতো দেয়ালে বা গাছে রঙিন চিত্রকর্ম আঁকা আছে। নাগরদোলা ছাড়াও বেশ সাজানো-গোছানো করার চেষ্টার ছাপ রয়েছে ওই খেলাঘরে। সম্প্রতি শিশুদের এই অনন্য এই খেলাঘর বা খেলার মাঠ দেখতে আসেন জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মী। ছোট্ট একটি শিশু তাদের বলছিল, ‘আমি ও আমার বন্ধু এখানে এসেছি। কারণ হলো এটা এখন পর্যন্ত একমাত্র থিম পার্ক যেখানে এখনো খেলাধুলা করা যায়, [...] আমরা একখানে খেলতে যেতাম সেটাতে আক্রমণ হওয়ায় আর ওখানে খেলা যায় না।’

খেলার জন্য ছোট ছোট ঘরে বেশ নিরাপদেই এরা খেলা করে। ছবি: ইউনিসেফের সৌজন্য
খেলার জন্য ছোট ছোট ঘরে বেশ নিরাপদেই এরা খেলা করে। ছবি: ইউনিসেফের সৌজন্য

সাত বছরের মাসা, নিরাপদে খেলাধুলা করার জন্যই কাছের অন্য একটি শহর থেকে এখানে এসেছে। সে বলছে, ‘আমি গোলাবর্ষণে ভয় পাই না কারণ বাবা বলেছে, আমরা ভূগর্ভস্থ কক্ষে আছি।’

ভূগর্ভস্থ এ খেলার মাঠে প্রতিদিন দুই শতাধিক শিশু খেলতে আসে। এই শিশুদের খেলার মতোই অবরুদ্ধ একটি এলাকায় ভূগর্ভস্থ একটি জায়গায় ৫০ বালিকা যেন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ইয়াসিন নামের এক শিশু এ খেলাঘরগুলোকে শিশুদের জন্য ‘শৈশবের নকশা ভূমি’ বলে ইউনিসেফ স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে ব্যাখ্যা করে। এগুলো খুঁড়ে তৈরি করার পরই রঙিন বাতির ব্যবস্থা ও খেলনা সামগ্রীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইয়াসিন বলছে, ‘ভয়, আতঙ্ক থেকে মুক্ত হয়ে আমরা একটি মজার জায়গায় সময় পার করি।’

খেলনা ঘোড়ায় দুই শিশুর খেলা। ছবি: ইউনিসেফের সৌজন্য
খেলনা ঘোড়ায় দুই শিশুর খেলা। ছবি: ইউনিসেফের সৌজন্য

জাতিসংঘ বলছে, পাঁচ বছর ধরা চলা গৃহযুদ্ধ ও সহিংসতায় সিরিয়ার অবরুদ্ধ হয়ে বাস করা শিশুদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। সারা প্রায় পাঁচ লাখ শিশু ১৬টি এলাকায় অবরোধ অবস্থায় বাস করছে। গত দুই বছর ধরে পুরোপুরি মানবিক সাহায্য এবং মৌলিক সেবা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি লেক ইনডিপেনডেন্টকে বলেন, ‘লাখ লাখ সিরিয়াবাসীর জন্য জীবন অবিরাম দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে হাজার হাজার শিশুর অবস্থা আরও ভয়ানক। শিশুরা মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। এতই ভয় যে কেউ খেলতে বা স্কুলে যেতে পারে না। বেঁচে থাকার জন্য সামান্য খাদ্য এবং ওষুধ নিয়ে কোনো রকমে তারা টিকে আছে। এভাবে বাঁচার কোনো পথই নেই, অনেকেরই মৃত্যু হয়।’

দুই মাসের কঠোর পরিশ্রমের ফল শিশুদের এই খেলাঘরটিতে নাগরদোলায় আপন মনেই খেলছে শিশুরা। ছবি: ইউনিসেফের সৌজন্য
দুই মাসের কঠোর পরিশ্রমের ফল শিশুদের এই খেলাঘরটিতে নাগরদোলায় আপন মনেই খেলছে শিশুরা। ছবি: ইউনিসেফের সৌজন্য

আরও পড়ুন: