মদ-জুয়া থেকে দাবায় মুক্তি

গ্রামের চা-দোকানি উন্নিকৃষ্ণান দাবা খেলায় মগ্ন। আলতো ঘোড়ার চালটা দিয়ে প্রতিপক্ষের কালো রাজাকে যখন বিপাকে ফেললেন, তখন তাঁর চোখে-মুখে সুনিশ্চিত জয়ের উচ্ছ্বাস। দোকানে এ রকম আনন্দময় আয়োজন নিয়মিত জমে ওঠে। সচল একখানা টেলিভিশন সেট সেখানে আছে বটে, তবে সেটা বেশির ভাগ সময়ই বন্ধ থাকে।
বছর পঞ্চাশেক আগে মারোত্থিকাল পাহাড়ের ওই গ্রামে মাতলামি আর বেআইনি জুয়ার ছড়াছড়ি ছিল। তবে উন্নিকৃষ্ণান সেখানকার মানুষকে দাবা খেলতে শেখানোর পর দৃশ্যপট আমূল বদলে গেছে।
ভারতের কেরালা রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামটির লোকজন কীভাবে এমন বুদ্ধির খেলায় বুঁদ হলেন, সেই প্রশ্নে উন্নিকৃষ্ণানের জবাব, ‘দাবা আমাদের বিভিন্ন সমস্যা ও দুর্ভোগ জয় করতে সাহায্য করে। একটা দাবার বোর্ডে যেমন লড়াই হয়, প্রাত্যহিক জীবনেও ঠিক তেমনি আমরা লড়ি।’
দোকানের উল্টো দিকে একটা বাসস্টপেজ। সেখানে ভিড় অনেক। কিন্তু কেউ কোথাও যাচ্ছে না, বরং জড়ো হয়ে দুই ভদ্রলোকের দাবা খেলা দেখছে। খালি পা, আসন করে বসা লোকজন—পরনে লুঙ্গি। ছেলে-বুড়ো সবাই এই খেলা দেখে। উন্নিকৃষ্ণানের দোকানের সামনে প্রতিদিন অন্তত তিনটি জোর লড়াই জমে দাবার।
মারোত্থিকাল দাবা অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান বেবি জন বলেন, ভারতের অন্যান্য গ্রামে দাবা খেলা হলেও এখানকার মতো বেশি নয়। এই গ্রামে চার থেকে ছয় হাজার মানুষ প্রায় প্রতিদিন দাবা খেলছে। আর এ জন্য ধন্যবাদের দাবিদার একজনই, তিনি উন্নিকৃষ্ণান।
পাঁচ দশক আগে কেরালার অন্যান্য গ্রামের সঙ্গে মারোত্থিকালের তফাত ছিল সামান্যই। মদ-জুয়ার দাপটে এই ছোট্ট জনগোষ্ঠী সাংঘাতিক অশান্তির মধ্যে দিনযাপন করত। উন্নিকৃষ্ণান তখন পাশের শহর কাল্লুর থেকে এসে এই গ্রামে চা-বিক্রি শুরু করেন। তিনি নিজ উৎসাহে ক্রেতাদের ডেকে দাবা খেলা শেখাতেন। বলতেন, এটা সময় কাটানোর ভালো উপায়। বিস্ময়করভাবে লোকে সহজেই খেলাটিকে গ্রহণ করে। দেখতে দেখতে এটা তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ভারতে দাবা খেলার প্রচলন সম্ভবত ষষ্ঠ শতকে। বেবি জন বলেন, ‘এখানে দাবা খেলায় মাদকের চাইতে বেশি আসক্তি গড়ে উঠেছে মানুষের। এটা আমাদের সৌভাগ্য বৈকি। এই খেলা মানুষের মনোযোগের উন্নতি করে, চরিত্রও দৃঢ় করে এবং একটা সাংগঠনিক ঐক্য গড়ে তুলতে সাহায্য করে। আমরা এখন টেলিভিশন দেখার বদলে দাবা খেলে এবং পরস্পর কথা বলে বেশি সময় কাটাই। শিশুরাও এতে আকৃষ্ট হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমরা শিশুদের দাবা শেখানো বন্দোবস্ত করেছি।’