প্রজন্মের কাছে শান্তির আকুতি

হিরোশিমার মেয়র কাজুমি মাৎসুই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন l ছবি: প্রথম আলো
হিরোশিমার মেয়র কাজুমি মাৎসুই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন l ছবি: প্রথম আলো

কাজুমি মাৎসুই ২০১১ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো চার বছর মেয়াদে আণবিক বোমা হামলার শিকার জাপানের হিরোশিমার মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ২০১৫ সালের এপ্রিলে পুনর্নির্বাচিত হন তিনি। জাপানের সব পৌর প্রশাসনের মধ্যে আণবিক বোমা হামলায় বিধ্বস্ত দুই শহর হিরোশিমা আর নাগাসাকির মেয়র সব সময়ই গণমাধ্যমের বাড়তি নজর কাড়তে পেরেছেন। ফলে বিশ্ব রাজনীতিতেও সীমিত পর্যায়ে হলেও কিছু প্রভাব এ দুই মেয়রের রয়েছে।

বিগত বছরগুলোতে দুটি ঘটনা হিরোশিমার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এক, ২০১৬ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার হিরোশিমা সফর। দুই, গত মাসে জাতিসংঘের ১২২টি সদস্যরাষ্ট্রের সম্মেলনে গৃহীত পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে যোগ দিতে জাপানের অনীহা প্রকাশ। প্রথম ঘটনাটির তাৎপর্য সার্বিক অর্থে প্রতীকী হলেও দ্বিতীয় ঘটনাটির ক্ষেত্রে বলা যায়, জাপানের আচরণে হিরোশিমা হতাশ। কেননা, সাত দশকের বেশি সময়জুড়ে বিশ্বে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের যে আহ্বান হিরোশিমা জানিয়ে আসছে, পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি হিরোশিমার সেই আহ্বানের সঙ্গেই সংগতিপূর্ণ। ফলে বছরের পর বছর ধরে জাপান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের যৌথ প্রস্তাবক থেকে গেলেও একেবারে মোক্ষম সময়ে দেশের এই পিছু হটা হিরোশিমাকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করছে।

১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যথাক্রমে ৬ ও ৯ আগস্ট আণবিক বোমা ফেলা হয়। এই প্রেক্ষাপটে হিরোশিমায় আণবিক বোমা হামলার আরেকটি বার্ষিকী এগিয়ে আসার আগে প্রথম আলোর প্রতিনিধিসহ টোকিওভিত্তিক কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক গত মাসের শেষ সপ্তাহে মুখোমুখি হয়েছিলেন হিরোশিমার মেয়র কাজুমি মাৎসুইয়ের।

মেয়র তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, হিরোশিমা শুধু আণবিক বোমা হামলায় বিধ্বস্ত ভবন সংরক্ষণ আর ধুলায় পরিণত হওয়া শহরে আবারও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে এনে আণবিক বোমা হামলার স্মৃতিকেই ধরে রাখছে না; একই সঙ্গে আণবিক বোমা হামলার ধ্বংসযজ্ঞের বার্তা বিশ্বের নানা প্রান্তে পৌঁছে দিয়ে পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তির মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব নিয়মিতভাবে তুলে ধরছে।শান্তির বার্তা প্রচারে শহরের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন বোমা হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া ভুক্তভোগীরা, হিবাকুশা নামে সারা বিশ্বে যাঁরা এখন কমবেশি পরিচিত। ৬ আগস্ট হিরোশিমা বার্ষিকীতে প্রতিবছর মেয়র শান্তির ঘোষণা প্রচার করেন। ওই ঘোষণায় প্রতিফলিত হয়, হিরোশিমার অভিজ্ঞতার আলোকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয়।

তিনি জানান, হিরোশিমার নেতৃত্বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেয়রদের সংগঠন মেয়রস ফর পিসের মাধ্যমে এক অনন্য শান্তি আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই ফোরামের সদস্যসংখ্যা এখন ১৬২টি দেশের ৭ হাজার ৩৯২টি শহর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ওই শহরগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা হচ্ছে ১০০ কোটি বা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-সপ্তমাংশ।

প্রশ্নোত্তর পর্বে কাজুমি মাৎসুইয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সরকারকে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে যোগদানে রাজি করাতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের চিন্তাভাবনা করছেন কি না। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী সব কটি দেশের চুক্তির বাইরে থাকায় হতাশা ব্যক্ত করলেও চুক্তি নিয়ে জাপানের অবস্থান হিরোশিমার মেয়রকে সবচেয়ে বেশি আশাহত করেছে। কাজুমি মাৎসুই বলেন, দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসল এই চুক্তিতে আণবিক বোমা হামলার শিকার একমাত্র দেশ হিসেবে এটির বাস্তবায়নে জাপানের বিশেষ ভূমিকা রাখা উচিত ছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি সেটা হয়নি। পরমাণু অস্ত্রের ছত্রচ্ছায়ায় জাপান অবস্থান করায় পরমাণু শক্তিধর দেশ এবং পরমাণু অস্ত্র যাদের নেই, সেই দুই বিভাজনের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করার চমৎকার সুযোগ আছে জাপানের। তাই জাপান সরকারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

আণবিক বোমা হামলার সরাসরি শিকার হওয়া প্রজন্ম এখন বার্ধক্যের সীমানায় এসে পৌঁছেছে। মর্মান্তিক সেই স্মৃতি বিশ্বাসযোগ্যভাবে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে এ পর্যন্ত ৮৯ জন প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীকে সনদ দেওয়া হয়েছে, যাঁদের গড় বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। তরুণদের পরিবর্তে মধ্যবয়সীদের প্রশিক্ষণের জন্য বেছে নেওয়ার কারণ হচ্ছে, তরুণেরা এতে যুক্ত হলে তাঁদের মুখে উচ্চারিত অতীতের কথা খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্য না-ও শোনাতে পারে। হিবাকুশাদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা ও শান্তির জন্য তাঁদের আকুতি আগামী প্রজন্মের কাছে অবশ্যই পৌঁছে দেওয়া দরকার। কীভাবে তা করা যায়, সেটা নিয়ে নানা রকম চিন্তাভাবনা নগর প্রশাসন সব সময় করে আসছে।

বারাক ওবামার হিরোশিমা সফর সম্পর্কে জানতে চাইলে মেয়র মাৎসুই বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলেন হিরোশিমা সফরে আসা এমন এক ব্যক্তি, যাঁর একটি আঙুল রাখা আছে পরমাণু অস্ত্রের বোতামে। হিরোশিমা হচ্ছে এমন এক স্থান, যেটা কিনা যুদ্ধ ও শান্তি নিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তাভাবনার খোরাক জোগায়। তাঁর মতে, হিরোশিমা হয়তো পরমাণু অস্ত্র নিয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও ভিন্নভাবে চিন্তা করে দেখার সুযোগ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দিয়ে থাকবে।

উত্তর কোরিয়ার হুমকি সম্পর্কে মেয়রের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। কাজুমি মাৎসুই বলেন, যেসব পরমাণু অস্ত্র এখন বিশ্বের কয়েকটি দেশের হাতে রয়েছে, ক্ষমতার দিক থেকে সেগুলো অনেক বেশি বিধ্বংসী। উত্তর কোরিয়ার নেতৃত্ব পরমাণু শক্তির ক্ষমতায় বিশ্বাসী এবং সেই বিশ্বাস থেকে দেশটি পরমাণু অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি এগিয়ে নিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে একে অন্যের প্রতি হুমকি নয়, বরং সংলাপে বসাই হচ্ছে একমাত্র বিকল্প, যা সব পক্ষকে সঠিক পথ দেখিয়ে দেবে।

বিদায় নেওয়ার আগে বাংলাদেশের জন্য একটি বার্তা হিরোশিমার মেয়র পৌঁছে দিতে বলেছেন। তিনি চাইছেন, বাংলাদেশের আরও বেশি পৌর প্রশাসন যেন ‘মেয়রস ফর পিস’ উদ্যোগে যোগ দেয়। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, বিশ্বের ৭ কোটির অধিক জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বমূলক ফোরামে যত বেশি শহর অংশ নেবে, বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ততই বেশি শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে।