উত্তর কোরিয়া হামলা চালালে...

উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ‘হাইড্রোজেন বোমা’ পরিদর্শনে কিম জং উন। ছবি: রয়টার্স
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ‘হাইড্রোজেন বোমা’ পরিদর্শনে কিম জং উন। ছবি: রয়টার্স

উত্তর কোরিয়া গত রোববার তাদের ষষ্ঠ পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। দেশটির চালানো পরীক্ষাগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা বলে ধারণা করা হচ্ছে। পিয়ংইয়ং দাবি করেছে, তারা হাইড্রোজেন বোমার সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। হাইড্রোজেন বোমা পারমাণবিক বোমার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি শক্তিশালী, যা উত্তর কোরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে সক্ষম। বিশ্লেষকেরা বলছেন, উত্তর কোরিয়ার এ দাবি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।

সাধারণ পারমাণবিক বোমার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণের ক্ষমতা আলাদাভাবে ৫০ বা ১২০ কিলোটন। ১৯৪৫ সালে হিরোশিমায় যে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ হয়েছিল, তার ক্ষমতা ছিল মাত্র ১৫ কিলোটন। এতেই ওই অঞ্চলে প্রায় ৮০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। উত্তর কোরিয়া যদি এই বোমার সত্যি সত্যি বিস্ফোরণ ঘটায়, তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কেমন হবে তা ধারণার বাইরে।

উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন দেশটির সবশেষ ও সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক বোমার পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ‘যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাইছেন’ বলে মত দিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন দূত নিকি হেলি। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠকে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ চাইছে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাদের ধৈর্য সীমাহীন। উত্তর কোরিয়ার ওপর বাড়তি নিষেধাজ্ঞা আরোপে যুক্তরাষ্ট্রের মরিয়া ভাবের কথা নিকি হেলির কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি বলেছেন, বাড়তি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কূটনৈতিক পথে উত্তর কোরিয়াকে ফেরানো সম্ভব।

পারমাণবিক বোমার পরীক্ষার কারণ
পারমাণবিক অস্ত্র টিকে থাকার সর্বশেষ একটি অস্ত্র। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, উত্তর কোরিয়া এই অস্ত্র প্রথমেই ব্যবহার করবে না। কিমের কাছে তাঁর পরিবার ও ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই মুখ্য। তিনি জানেন, পারমাণবিক অস্ত্র সত্যি সত্যি ব্যবহার করলে অনিবার্যভাবে যুদ্ধ লেগে যাবে, যে যুদ্ধে কোনোভাবেই উত্তর কোরিয়ার জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মূলত কিম এ ধরনের পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন। দেখাতে চাইছেন, তাঁদের কাছে শক্তিশালী অস্ত্র আছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের কুকমিন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আন্দ্রেই লানকভ বলেন, ‘উত্তর কোরিয়ার নেতারা জানেন, মৃত মানুষের অর্থের কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁরা বিশ্বাস করেন, পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়া তাঁরা মৃত মানুষের মতোই হয়ে যাবেন।’

যুদ্ধ শুরু হচ্ছে?
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস হুঁশিয়ার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্র দেশের প্রতি পিয়ংইয়ংয়ের যেকোনো হুমকির জবাব ব্যাপক সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে দেওয়া হবে। উত্তর কোরিয়াকে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার বিষয়েও ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র।

উত্তর কোরিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালাবে কি না, গত রোববার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’

উত্তর কোরিয়ার ওই পরীক্ষার প্রতিক্রিয়ায় গত সোমবার ক্ষেপণাস্ত্রের লাইভ মহড়া চালিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। সিউল জানিয়েছে, গত সপ্তাহান্তে পিয়ংইয়ংয়ের ‘হাইড্রোজেন বোমা’র পরীক্ষা চালানোর পর তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাডের (টার্মিনাল হাই-অলটিচিউড এরিয়া ডিফেন্স) মোতায়েন আরও বাড়াবে তারা। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাড লঞ্চার মোতায়েন করবে অস্থায়ীভাবে আরও চারটি। এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা স্বল্প, মাঝারি ও মধ্যবর্তী পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র আকাশেই ধ্বংস করে দিতে সিউলের দক্ষিণের সিইয়ংজু এলাকায় ইতিমধ্যে দুটি থাড রয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ায় কোনো হামলা চালালে প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। চলতি বছর উত্তর কোরিয়ার দুটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও গত রোববারের হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র এখন কিছুটা পরমাণু হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, উত্তর কোরিয়ার দাবি যাচাই করা খুব কঠিন ব্যাপার। তবে তাদের দাবি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।

কিম হামলা চালালে কী হবে?
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের গুয়ামে জলসীমায় চারটি ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর হুমকি দিয়েছিল পিয়ংইয়ং। পরে তারা জাপানের ওপর দিয়ে একটি ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। তাই এখন চাইলে হামলাও চালাতে পারে—এ আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরও জোরদার করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাড যুক্ত করেছে, যা স্বল্প, মাঝারি ও মধ্যবর্তী পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং জাহাজভিত্তিক এইজিস ব্যবস্থা ধ্বংস করতে সক্ষম। এই ব্যবস্থা একসঙ্গে ১০০টি ক্ষেপণাস্ত্র নজরদারি করে তা আটকে দিতে পারে, যাতে কোনো ঝুঁকি নেই।

উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাডের নকশা। ছবি: মার্কিন মিসাইল ডিফেন্স এজেন্সি
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাডের নকশা। ছবি: মার্কিন মিসাইল ডিফেন্স এজেন্সি

যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প ভাবনা
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা এখনো এতে সফল হতে পারেনি।

পিয়ংইয়ংয়ের সর্বশেষ পরমাণু পরীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে নিউইয়র্কে সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক হয়। সেখানে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন দূত নিকি হেলি বলেন, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন ‘যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাইছেন’। পারমাণবিক পরীক্ষার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত জানাবে। আগামী সপ্তাহে এ নিয়ে ভোটের আয়োজন করারও পরিকল্পনা রয়েছে।

বৈঠকের আগ দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের নেতারা উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘের আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে একমত হন বলে জানিয়েছেন সিউলের এক মুখপাত্র। এর আগে সবশেষ গত আগস্টে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ উত্তর কোরিয়ার রপ্তানি খাতকে লক্ষ্য করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, পিয়ংইয়ংয়ের কাছে যে ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, তা রেখে আর যেন নতুন কোনো ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা না চালায়, এ জন্য উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বসে আলোচনা করা উচিত।

এ প্রসঙ্গে আন্দ্রেই লানকভ বলেন, আসলে খারাপ ও নিকৃষ্ট এই দুইয়ের মধ্যে যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।

আর কে সহায়তা করতে পারে?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনকে তাঁর প্রতিবেশী পিয়ংইয়ংয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাহায্য করতে উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু পিয়ংইয়ংকে জোর করার মতো সক্ষমতা বেইজিংয়ের আছে, এই বিশ্বাস হোয়াইট হাউসের আছে কি না, বিশ্লেষকেরা তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।

তবে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষায় জাতিসংঘের কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপে নিয়মিত সমর্থন দিয়ে আসছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, পিয়ংইয়ংকে চাপ দেওয়ার মতো যথেষ্ট অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেইজিংয়ের নেই। চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোকেও উত্তর কোরিয়ায় নিষেধাজ্ঞা আরোপে হুমকি দিতে পারছে না দেশটি।

চীন বারবার বলে আসছে, উত্তর কোরিয়ার ওপর একা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তা খুব একটা কাজে আসবে না। পিয়ংইয়ংকে থামানোর বিনিময়ে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া সামরিক চুক্তি সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করতে পারে। তবে সোমবারের বৈঠকে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন দূত নিকি হেলি এই প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছেন।

সিএনএন, বিবিসি, রয়টার্স ও এএফপি অবলম্বনে আবু হেনা মোস্তফা কামাল