ত্রাণ পাঠাচ্ছে ভারত

ত্রাণের জন্য রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ লাইন। ছবিটি গতকাল বিকেলে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার থ্যাংখালী অস্থায়ী আশ্রয়শিবির এলাকা থেকে তোলা l আশরাফুল আলম
ত্রাণের জন্য রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ লাইন। ছবিটি গতকাল বিকেলে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার থ্যাংখালী অস্থায়ী আশ্রয়শিবির এলাকা থেকে তোলা l আশরাফুল আলম

বিভিন্ন মহলে সমালোচনার মুখে পড়া ভারত সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বাংলাদেশে ত্রাণ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের অস্থায়ী শিবিরগুলোতে এই ত্রাণসামগ্রী কীভাবে কত দ্রুত পাঠানো যায়, আপাতত তা বিবেচিত হচ্ছে। এই ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে খাদ্য যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে ওষুধপথ্য ও অস্থায়ী শিবির তৈরির সরঞ্জাম।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা দিল্লি এসে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনাও করেছেন। সূত্রের খবর, ভারতের ত্রাণসামগ্রী স্থল, জল ও আকাশপথে বাংলাদেশে পাঠানোর বিষয়ে িচন্তাভাবনা চলছে। সরকার চায় যত দ্রুত সম্ভব ত্রাণসামগ্রী বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে।

ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন জানিয়েছে, আজ বৃহস্পতিবার সকালে ভারতের ত্রাণবহরের প্রথম চালান চট্টগ্রামে পৌঁছাবে। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দেবেন হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে ভারত। দেশের ভেতরেও বিরোধীদের সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার। রোহিঙ্গা উচ্ছেদ ও গণহত্যা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের ভূমিকার কড়া নিন্দা করেছে জাতিসংঘ। এই অবস্থায় সমালোচনা ঠেকাতে ভারতের ত্রাণ পাঠানোর চিন্তাভাবনা। ভারত এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে এটা বোঝাতে সচেষ্ট যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভারতে চলে আসা দেশের নিরাপত্তার দিক দিয়ে বিপজ্জনক হলেও ভারত তার মানবিক দিকটা অস্বীকার করছে না। সে জন্যই লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য ত্রাণ পাঠানোর কথা ভারত ভেবেছে।

বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মুয়াজ্জেম আলী গত সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্করের সঙ্গে দেখা করে এই সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন। সমস্যা বাংলাদেশের পক্ষে কতটা ভয়ংকর, তা তিনি বোঝান। দুটি বিষয়ে তিনি ভারতকে সক্রিয় হওয়ার অনুরোধ জানান। এক. মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হওয়া, যাতে ঘরছাড়া রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে যেতে পারে। দুই. লাখ লাখ শরণার্থীর বাংলাদেশে চলে আসা যে সংকটের সৃষ্টি করেছে, তার সমাধানে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো।

গত সপ্তাহের ওই বৈঠকের চার ঘণ্টার মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়। সেই বিবৃতিতে মিয়ানমার সরকারকে শান্তিপূর্ণভাবে এই সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হতে বলা হয়। এর আগে মিয়ানমার সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সন্ত্রাস দমনে সে দেশের সরকারের উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।

কিন্তু বিবৃতিতে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার কথা উল্লেখ করা সত্ত্বেও ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রতি সরকারি মনোভাবের সমালোচনা থেকে ভারত বেরোতে পারছে না। প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ভারতে কয়েক বছর ধরে বসবাস করছে বলে ভারতীয় সরকারি হিসাব। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু সরাসরিই বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদীরা ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে। ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জম্মু-কাশ্মীরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআই জাল বিছিয়েছে। জইশে মুহাম্মদ, লস্কর-ই-তাইয়েবা কিংবা সিমি-হুজির মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোও রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে। সব রোহিঙ্গাকে ভারত ফেরত পাঠাবে বলে সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছেন ভারতীয় শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরাই। তাঁদের মতে, এ দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশকারী। অবৈধভাবে তারা শুধু ভারতেই চলে আসেনি, তারা দেশের নিরাপত্তার পক্ষে ভয়ংকর রকমের বিপজ্জনক।

এই অবস্থান ভারতকে দেশের অভ্যন্তরে যেমন, বাইরেও ফেলে দিয়েছে চরম সমালোচনার মুখে। ভারতের সরকার অমানবিক, এমন প্রচারও শুরু হয়েছে। এই প্রচার ভোঁতা করতেই ত্রাণ পাঠানোর সিদ্ধান্ত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাংশের ধারণা, ভারতীয় ‘উদাসীনতায়’ বাংলাদেশও আহত। ভারত সেই ‘আঘাতে’ প্রলেপ দিতে চায়। এই অংশের মতে, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তো বটেই, বাংলাদেশের কাছেও ত্রাণের প্রয়োজনীয়তা প্রবল। ভারত যে তার সবচেয়ে বড় বন্ধু, ভারত যে এই সময়ে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে, ত্রাণ পাঠানোর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ভারত তারই প্রমাণ দিতে চাইছে।