ছন্নছাড়া থেকে রানির রাঁধুনি!

একসময় ছিলেন গৃহহীন। এখন সামাজিক উদ্যোগের কল্যাণে রাঁধুনি হিসেবে নাম করেছেন লিওন সেরাফিন। ছবি: রয়টার্স
একসময় ছিলেন গৃহহীন। এখন সামাজিক উদ্যোগের কল্যাণে রাঁধুনি হিসেবে নাম করেছেন লিওন সেরাফিন। ছবি: রয়টার্স

লিওন সেরাফিন স্কুল ছেড়েছেন ১৪ বছর বয়সে। বেকার ছিলেন অনেক দিন। তারপর যা হয় আর কি! অভাবে স্বভাব নষ্ট। ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়লেন পুলিশের হাতে। বছর খানেক কারাগারে কাটাতে হলো।

২০০৪ সালে চাকরিবিষয়ক একটি দাতব্য সংস্থা লিওনকে কাজের প্রস্তাব দেয়। পূর্ব লন্ডনের একটি রেস্তোরাঁয় শিক্ষানবিশ কর্মীর কাজ। এটি দিয়েই চাকরিজীবন শুরু হয় লিওনের। তাঁর মতে, চাকরি কীভাবে টিকিয়ে রাখতে হয়, তা এই সুযোগেই শেখেন তিনি। ওই সময় ভোরে ঘুম থেকে উঠে কর্মস্থলে পৌঁছাতে হতো লিওনকে।

এখন একজন পাকা রাঁধুনি লিওন। কাজ করেন ব্রিগেড নামক লন্ডনের একটি রেস্তোরাঁয়। রেস্তোরাঁটি গৃহহীন মানুষদের প্রশিক্ষণ দেয়। পরে চাকরিও দেয়। লিওন বলেন, ‘আমি রানির জন্যও কখনো কখনো রান্না করি। এসবের মধ্যে আছে, ভাপ দিয়ে স্যামন মাছ, ভেড়ার মাংস, রুটি ও মাখন দিয়ে পুডিং।’

যুক্তরাজ্যে বর্তমানে সামাজিক উদ্যোগে পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পসার বেড়েছে। দেশটিতে এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮০ হাজারের মতো। লিওনের মতো প্রায় ১০ লাখ মানুষ এখন যুক্তরাজ্যের এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বেঁচে-বর্তে আছেন। দেশটিতে সামাজিক উদ্যোগে পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্থা সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ ইউকে এ তথ্য জানিয়েছে।

সামাজিক উদ্যোক্তা হলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলার জন্য বাণিজ্যিক কলাকৌশল ব্যবহার করেন। এর মূল লক্ষ্য হলো একই সঙ্গে সামাজিক কল্যাণ করা ও আর্থিক মুনাফা নিশ্চিত করা। গত দশক থেকেই যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসার মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নের জোয়ার উঠেছে।

রাসেল গিল একজন ভোক্তা সমবায়ের কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘সামাজিক উদ্দেশ্য না থাকলে, কোনো খাতই লাভবান হয় না। বাণিজ্যেও এ বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। সামাজিক সম্প্রদায়ের ইস্যুগুলো ক্রেতাদের বিবেচনায় আনার কাজটি ব্যবসায়ীদের করতে হবে।’

বর্জ্য কমিয়ে পরিবেশ রক্ষা

যুক্তরাজ্য ও বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এগুলো পরিবেশগত টেকসই বিকল্প তৈরি করছে। লন্ডনের দমকল বাহিনীর ব্যবহৃত মেয়াদোত্তীর্ণ হোসপাইপ দিয়ে ছোট ব্যাগ ও ওয়ালেট তৈরি করছে ব্রিটিশ কোম্পানি এলভিস অ্যান্ড ক্রেস। এগুলো সবই বিলাসবহুল পণ্য।

মাত্র ৪০ পাউন্ড পুঁজি নিয়ে ক্রেস ওয়েসলিং ও তাঁর স্বামী এলভিস এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন। এক সময় তাঁরা জানতে পারেন, প্রতি বছর ১০ টন পাইপ ফেলে দেয় লন্ডনের দমকল বাহিনী। তখনই তাঁদের মাথায় এগুলো ব্যবহারের বুদ্ধি আসে।

ক্রেস ওয়েসলিং বলেন, ‘আবর্জনা পুনর্ব্যবহারের বিষয়ে আমি বরাবরই আগ্রহী ছিলাম। তাই এ নিয়েই কাজ শুরু করি।’

অন্যদিকে খাদ্যসংক্রান্ত বর্জ্য কমাতেও কাজ করছে সামাজিক উদ্যোগে পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। সম্প্রতি লন্ডনে প্রথমবারের মতো এমন একটি সুপারমার্কেট চালু করা হয়েছে, যেখানে বর্জ্য থেকে বানানো পণ্য বিক্রি হচ্ছে। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের তৈরি চামচ, ক্ষুর ও স্পঞ্জ ব্যবহার করে বানানো হচ্ছে এসব পণ্য।

টোস্ট এল নামের একটি প্রতিষ্ঠান পানীয় তৈরি করছে ফেলে দেওয়া পাউরুটি দিয়ে। প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন ব্যবস্থাপক জুলি প্রেবল বলেন, ‘যুক্তরাজ্যে মোট পাউরুটির ৪৪ শতাংশ নষ্ট হয়। আর তা থেকেই আকর্ষণীয় স্বাদের পানীয় তৈরি করি আমরা। এই পানীয় টেকেও বহুদিন।’

ব্যবসায়িক মূল্য

রাসেল গিলের মতে, সামাজিক উদ্যোগে পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ক্রেতাদের প্রতি নজর দিতে হয় বেশি। আর প্রতিযোগিতাও নেহাত কম নয়।

ক্রেস ওয়েসলিং বলেন, ‘সামাজিক উদ্যোগে ব্যবসা চালানোর মানে এই নয় যে, পণ্যের মান খারাপ হতে হবে। আমাদের কারিগরেরা বিশ্বমানের। আমরা কম দামে পণ্য বিক্রি করতে পারি, কারণ আমাদের সুপারমডেল বা অসংখ্য শেয়ারহোল্ডার নেই।’

একদিক থেকে এই ব্যবসায় সর্বোচ্চ আর্থিক মূল্যমান নিশ্চিত করা হয়। বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন ক্রেস। তিনি বলেন, ‘আমাকে মেয়াদোত্তীর্ণ ১ হাজার কেজি চামড়ার পাইপ দিন। আমি আপনাকে তা থেকে এক লাখ পাউন্ড এনে দেব। আর এই অর্থের বেশির ভাগই খরচ হবে মানুষের বেতন দিতে।’

তবে এই ব্যবসায় মূলধন জোগাড় করাই একটি বড় বাধা। সামাজিক উদ্যোগে পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সহায়তা দেয় গুড ফিন্যান্স নামের একটি ওয়েবসাইট। এর কর্মকর্তা কিরন হোয়াইটসাইড বলেন, ‘সামাজিক বিনিয়োগ তখনই সঠিক হয়, যখন এটি পরিশোধ করা যায়। সুতরাং এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিজেদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল থাকা প্রয়োজন।’

রয়টার্স অবলম্বনে অর্ণব সান্যাল