'নিজেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অযোগ্য মনে করি'

প্রণব মুখার্জি
প্রণব মুখার্জি

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে চলতি সংখ্যায় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছে দেশটির প্রভাবশালী ইংরেজি সাপ্তাহিক ইন্ডিয়া টুডে। সেখানে তাঁর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন সাময়িকীটির সম্পাদকীয় বিভাগের পরিচালক রাজ চেঙ্গাপ্পা। সাক্ষাৎকারটির বিশেষ কিছু অংশ অনুবাদ করে তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন : ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের এমন পরাজয় হলো কেন? দলটি তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে কম আসন পেয়েছিল।
প্রণব মুখার্জি : আমরা প্রথম ইউপি সরকার ভালোভাবে পরিচালনা করেছিলাম। আমাদের ১৪৭টি ছিল। আমাদের জোটে একাধিক দল ছিল। বামেরা ছিল, সমাজবাদী ছিল। এরা বাইরে থেকে আমাদের সমর্থন করেছিল। খুব ভালোভাবে এটি চলছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় ইউপিএ সরকারের জোট অবশ্য ভালো করতে পারেনি।

প্রশ্ন : দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার ভালো করল না কেন?
প্রণব মুখার্জি : এর একটি কারণ, কংগ্রেস ভেবেছিল, তাদের পাওয়া ২০০ আসন আর ২৮০ আসন একই বিষয়। আর এর ফলে অন্যদের মত গ্রহণের মানসিকতা ক্রমে কমতে থাকে। আরেকটি কারণ, এই জোট সরকারের অন্যতম শরিক মমতা ব্যানার্জি ২০১২ সালে জোট ছেড়ে গেলেন। মমতার সঙ্গে কাজ করা খুবই কঠিন। লোকসভায় মমতার ১৯ আসন ছিল। তিনি বড় সহযোগী ছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর অনেক সময় বিরোধ তৈরি হয়েছে। তবে আমি সেসব সামলেছি। আমি জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি হলাম আর মমতা অক্টোবরে জোট ছাড়লেন। প্রথম ইউপিএ সরকার অনেক জটিল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু কেমন করে জানি দ্বিতীয় দফায় সেই গতি ছিল না। আমরা হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।

প্রশ্ন : ওই নির্বাচনে আপনার কি মনে হয়েছিল কংগ্রেস হারতে যাচ্ছে?
প্রণব মুখার্জি : নির্বাচনী প্রচার যখন একদম চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা আমার সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা বেশির ভাগই মন্ত্রী ছিলেন। তাঁরা যেসব কথা বলতেন, এর নোট রাখতাম আমি। এই নেতাদের বেশির ভাগই বলতেন, কংগ্রেস ১৬০ থেকে ১৭০ আসন পাবে। আর বিজেপি পাবে ১৮০। আশ্চর্যজনকভাবে শুধু পীযূষ গোয়েল আমাকে বলেছিলেন, বিজেপি ২৬০-এর নিচে আসন পাবে না। আর উনি প্রায় ঠিকই বলেছিলেন।

প্রশ্ন : ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে সোনিয়া গান্ধী ও মনমোহন সিংয়ের অনুমান কেমন ছিল?
প্রণব মুখার্জি : দল কত আসন পাবে, এ দুজন তা নিয়ে কোনো কথা আমাকে বলেননি। তবে তাঁরা বলেছিলেন, পরিস্থিতি খুব জটিল। সোনিয়া গান্ধী ভারতের অন্য রাজনীতিকদের থেকে একেবারে আলাদা। তিনি কখনো অতিরঞ্জিত কিছু বলেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি কখনো কাউকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন না। তিনি যদি কোনো কিছু না জানেন, তবে তিনি বলবেন, আমি জানি না। আমাকে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। এ ধরনের শুদ্ধতা তাঁর চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য।

প্রশ্ন : সোনিয়ার সঙ্গে আপনার সম্পর্ককে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
প্রণব মুখার্জি : একেবারে শুরুতে আমার বিষয়ে তিনি খুব ইতিবাচক ছিলেন না। কিন্তু বাজপেয়ি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। ১৯৯৮ সালে দলের সম্মেলনের পর তাঁর মনোভাব পরিবর্তন হয়। এরপর থেকেই তিনি আমাকে আস্থায় নিতে শুরু করেন।

প্রশ্ন : সোনিয়া প্রধানমন্ত্রী হলে ভালো প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন?
প্রণব মুখার্জি : এটা আমি কীভাবে বলব। বিষয়টি এমন হলো যে আপনি একটি ট্রেন মিস করলেন, যেটি স্টেশনেই আসেনি। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেনই না। আমি নিশ্চিত, তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের মানুষ তাঁকে অবশ্যই গ্রহণ করত। ২০০৪ সালে জনগণ তাঁকে ভোট দিয়েছিল। সোনিয়ার কর্মদক্ষতা ছিল। তবে কর্মদক্ষতা সব সময় প্রমাণ করে না যে আপনি ভালো নেতা হবেন। আপনি ভালো নেতা হতে পারেন, ভালো খেলোয়াড় হতে পারেন; কিন্তু আপনি যে ভালো ক্যাপ্টেন হবেন, তা না–ও হতে পারে। তবে সোনিয়ার ভালো ক্যাপ্টেন হওয়ার যোগ্যতা ছিল।

প্রশ্ন : আপনাকে বাদ দিয়ে মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী করায় আপনি কি হতাশ হয়েছিলেন?
প্রণব মুখার্জি : না। আমি তিন কারণে নিজেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য মনে করি। প্রথম অযোগ্যতা হলো, আমি আমার রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগ সময় রাজ্যসভার সদস্য ছিলাম। ২০০৪ সালে কেবল লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। দ্বিতীয় অযোগ্যতা হলো, লোকসভায় নির্বাচিত হলেও আমি হিন্দি বলতে পারতাম না। আর হিন্দি না জানলে কেউই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পারেন না। কামারাজ বলতেন, ‘নো হিন্দি নো প্রাইম মিনিস্টার’। আর আমার তৃতীয় অযোগ্যতা হলো, ১৯৭৭ সাল থেকে যে পশ্চিমবঙ্গের আমি প্রতিনিধিত্ব করে আসছি, সেখানে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসতে পারেনি। প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর পেছনে তাঁদের রাজ্য থাকে।

প্রশ্ন : রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি হচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। আপনার মতামত কী?
প্রণব মুখার্জি : তিনি উঠে আসছেন। কঠোর পরিশ্রম করছেন রাহুল। কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরাই ঠিক করুক তাঁদের নেতা। তাঁরা যথেষ্ট পারঙ্গম। এ দল ১৩২ বছরের পুরোনো।

প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন না এই উত্তরাধিকারের রাজনীতি আধুনিক গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়?
প্রণব মুখার্জি : উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং গণতান্ত্রিক ধারায় হওয়া উচিত। যৌথ অধিবেশনে প্রতিনিধিদের ভোটে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়। উত্তরাধিকার ধারার বাইরে কংগ্রেসে বার কয়েক পরিবর্তন আনা হয়েছে নেতৃত্বে। তবে সেসব উদ্যোগ সব সময় সফল হয়নি। নব্বইয়ের দশকে নরসীমা রাও ও সীতারাম কেশরীকে নেতৃত্বে আনা হয়েছিল।

প্রশ্ন : তাই আপনার মনে হয়, কংগ্রেস আজ যে অবস্থায় আছে, তা থেকে ঘুরে দাঁড়াবে?
প্রণব মুখার্জি : ১৩২ বছরের পুরোনো একটি দলকে আপনি হঠাৎ করে মুছে ফেলতে পারেন না। তবে এ জন্য কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সময় ও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের পরিবর্তন করার সক্ষমতা কংগ্রেসের আছে।

প্রশ্ন : সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোদি সরকারের প্রতি আপনার উপদেশ কী থাকবে?
প্রণব মুখার্জি : অন্য নানা বিষয়ের মধ্যে আমি মনে করি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে প্রচুর মূলধন সৃষ্টি করতে হবে। ভারতের সরকারি খাত আরও দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাংকিংয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। দ্বিতীয়ত, কোনো ধরনের ভীতি সৃষ্টি করা যাবে না। আবার একই সময় নানা পরিবর্তনও আনতে হবে। আসলে এর অনেক কিছুই নির্ভর করছে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর কর্মকাণ্ডের ওপর।

প্রশ্ন : হাজার টাকার নোট বাতিলের সময় মোদি আপনার সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন?
প্রণব মুখার্জি : নোট বাতিলের পরপরই তিনি আমার কাছে এসেছিলেন এবং পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি কালোটাকা রোধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি আমার সমর্থন চেয়েছিলেন; যেটা আমি সব সময়ই করি। নোট বাতিলের আগে নতুন নোট ছাপানো উচিত ছিল। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, নতুন নোট ছাপানো অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়।

প্রশ্ন : ২০০৮ সালে আপনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় মুম্বাই হামলা হলো। আপনি কি কখনো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের কথা ভেবেছিলেন?
প্রণব মুখার্জি : ২৬/১১-এর পর আমাদের পার্লামেন্ট বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। একজন এমপি বলে বসলেন, কেন আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযানে যাচ্ছি না। আমি তাঁকে বললাম, আমি কখনোই এ ধরনের হঠকারিতাকে প্রশ্রয় দেব না। সে সময় আমরা পাকিস্তানে হামলা করব কি না, তা নিয়ে এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসেরও ভাবনা ছিল। আমি তাঁকে বলেছিলাম, এর কোনো প্রশ্ন ওঠে না। কারণ, আমরা হঠকারী নই, আবার আবেগপ্রবণও নই। আমরা বুঝেছিলাম, পাকিস্তান পাকিস্তানই। আমরা যেমন চাই, তারা তা হবে না। তবে প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের পাশাপাশি থাকতে হবে। সশস্ত্র লড়াই কোনো ফল বয়ে আনবে বলে আমি মনে করি না।

প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন, এই বাড়তে থাকা অসহিষ্ণুতার মধ্যে ভারতীয় গণতন্ত্র নিরাপদে আছে?
প্রণব মুখার্জি : নানা সময় নানা কারণে বিচ্যুতি ঘটতে পারে। এটা অতীতেও ঘটেছে। এটা এখনো ঘটছে। আবার ভবিষ্যতেও এটা হতে পারে। তবে এসবই বিচ্যুতি। ভারতের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কখনোই অসহিষ্ণু নয়। ৭০, ৮০ ও ৯০-এর দশকে সরকারের সময় যা ঘটেছে, তা এখন সম্ভব নয়। ভারতীয় গণতন্ত্রের উন্নত মান নিয়ে আমি অভিভূত। ১৯৮৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জনগণ বিভক্ত রায় দিয়েছে। কংগ্রেস তার সবচেয়ে ভালো সময় ২০০৯ সালে ২০০ আসন পেয়েছে। বাজপেয়ি ১৮১ আসন নিয়ে ১৯৯৯ সালে সরকার গঠন করেছিলেন। যখন একটি জোট সরকার খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখন মানুষ এটাতে প্রতিক্রিয়া দেখাল। সবশেষ নির্বাচনে বিজেপিকে তারা বিপুল আসন দিল। আমি মনে করি, গণতন্ত্র সংহত। কারণ, ভারতের স্বাধীন বিচার বিভাগ বা নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী। এখানে শক্তিশালী জনমত এবং সুশীল সমাজ আছে।

প্রশ্ন : ৪৮ বছরের রাজনৈতিক জীবন আপনাকে কী শিক্ষা দিল?
প্রণব মুখার্জি : আমি একটি মৌলিক শিক্ষা পেয়েছি, তাহলো, কোনো বিষয়ে সংসদে আলোচনা, বিতর্ক—এগুলোর কোনো তুলনা নেই। অবশ্যই ভিন্নমত থাকবে। সংসদীয় গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য এ শিক্ষা সবাইকে নিতে হবে। আমি মানুষের কাছে থেকে অনেক কিছু শিখেছি, অনেক কিছু পেয়েছি।

ভাষান্তর : পার্থ শঙ্কর সাহা