রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর চাপ বৃদ্ধির আহ্বান

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের সাংসদেরা। তাঁরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের নিপীড়নকে জাতিগত নিধন (এথনিক ক্লিনজিং) আখ্যা দিয়ে প্রস্তাব পাস করেন।

মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের সংসদে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বিতর্কে দেশটির সাংসদেরা বলেন, রোহিঙ্গা নিধন বন্ধে বাধ্য করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। প্রয়োজনে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে সাবেক ঔপনিবেশিক সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁরা বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাজ্যের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনের দায় রয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন ব্রিটিশ সাংসদেরা।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে মিয়ানমারবিষয়ক সর্বদলীয় কমিটির চেয়ার লেবার পার্টির এমপি রুশনারা আলী এবং বাংলাদেশবিষয়ক সর্বদলীয় কমিটির চেয়ার ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির এমপি অ্যান মেইন ছিলেন এ বিতর্কের উদ্যোক্তা। বিতর্ক আয়োজনে ৭৩ জন এমপি সমর্থন দেন। দেশটির এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ডের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এ বিতর্কে ৩০ জনের বেশি এমপি অংশ নেন।
সাংসদদের আহ্বানের জবাবে প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড বলেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাজ্য তিন দফা রোহিঙ্গা পরিস্থিতির বিষয়টি তুলেছে। মিয়ানমারের ওপর চাপ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আলোচনার জন্য বিষয়টি আবারও নিরাপত্তা পরিষদে তোলার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে প্রস্তাব পাস করতে গেলে রাশিয়া ও চীনের সমর্থন জরুরি। দেশ দুটি প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেবে বলেই তাঁর ধারণা। রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকট সমাধানে যুক্তরাজ্যের নানা তৎপরতার কথা তুলে ধরেন প্রতিমন্ত্রী।

ব্রিটিশ এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য এ অঞ্চলের প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকা জরুরি। যে কারণে মতভিন্নতা সত্ত্বেও যুক্তরাজ্য চীন এবং ভারতের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা নিশ্চিত করতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরই কেবল রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে পারে মন্তব্য করে মার্ক ফিল্ড বলেন, বর্তমানে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো উপেক্ষিত হলে ভবিষ্যতের সামরিক শাসকেরা একই রকম দায়মুক্তি নিয়ে আচরণ করার সাহস পেয়ে বসবে।

লেবার পার্টির এমপি সারাহ চ্যাম্পিয়ান প্রশ্ন রেখে বলেন, জাতিসংঘ যদি এটিকে গণহত্যা বলে বিবেচনা করে, তাহলে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে বিষয়টি বিচারের জন্য যুক্তরাজ্য সমর্থন দেবে কি না? জবাবে যুক্তরাজ্য সমর্থন দেবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
বিতর্কের সূচনা বক্তব্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি রুশনারা আলী রোহিঙ্গাদের ঐতিহাসিক পরিস্থিতির বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেন। জানান, ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। কেবল জাতিগত নিধন আখ্যা দিলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। গণতন্ত্রে রূপান্তরের অপেক্ষা করে বসে থাকার বিষয়টিও আর গ্রহণযোগ্য নয়। এ সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপের আহ্বান জানান তিনি।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথবিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী হুগো সোয়ার বলেন, রোহিঙ্গারা শত শত বছর ধরে মিয়ানমারের বাসিন্দা। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকারের বিষয়টি অগ্রহণযোগ্য।

অ্যান মেইন সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, আশ্রিত মানুষের মধ্যে ৮০ হাজারের বেশি গর্ভবতী নারী রয়েছেন। আছে ৩০ হাজারের বেশি অভিভাবকহীন শিশু। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা নিজেরা নিজেদের ঘরে আগুন দিচ্ছে বলে যেসব সংবাদমাধ্যম খবর দিচ্ছে—তারা মিথ্যাচার করছে।
লেবার পার্টির এমপি লিন ব্রাউন বলেন, তাঁর নির্বাচনী আসনের বাসিন্দারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে ব্রিটিশ সরকারের আরও জোরালো ভূমিকা দেখতে চায়। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে একজন মহান নারী ভেবেছিলেন জানিয়ে এই এমপি বলেন, মহান নারী কখনো জাতিগত নিধন সহ্য করতে পারেন না।
ব্রাডফোর্ড ইস্ট আসনের এমপি ইমরান হোসেন বলেন, ‘মিয়ানমারে আমরা গণতন্ত্র চাই। কিন্তু সেই রূপান্তরের পথ এমন অন্যায় আর মিথ্যাচারপূর্ণ হতে পারে না।’
ব্রিটিশ সরকারের করণীয় সম্পর্কে কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরে টিউলিপ সিদ্দিক বলেন, নির্যাতিত লোকদের কাছে সাহায্য পৌঁছানোর সুযোগ করে মিয়ানমারকে বাধ্য করা উচিত। বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞাগুলো আরোপ করতে ইইউকে যুক্ত করা উচিত। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে, এমন সব বাণিজ্য বিনিয়োগ যোগাযোগ বন্ধে জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত।
জ্যাক গোলডস্মিথ, ক্যারোলাইন লুকাস, ডেভিড লামি, ক্রিস ল এবং এলিনর স্মিথসহ বিভিন্ন এমপি মিয়ানমারের নেত্রীর অং সান সু চির ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। ব্রিটিশ এমপিরা বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।