মাও সে-তুংয়ের পর চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসের পর চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে-তুংয়ের পর দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনীতিবিদ হিসেবে সি চিন পিংয়ের নাম চলে এসেছে। ছবি: রয়টার্স
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসের পর চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে-তুংয়ের পর দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনীতিবিদ হিসেবে সি চিন পিংয়ের নাম চলে এসেছে। ছবি: রয়টার্স

গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে-তুংয়ের পর দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনীতিক হিসেবে আবির্ভূত হলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। সি চিনকে আরও ক্ষমতাধর করতে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির গঠনতন্ত্রে সংশোধন আনা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

সি চিন পিংয়ের ‘নতুন যুগে সি চিন পিংয়ের চীনা সমাজতান্ত্রিক চিন্তা’ সংযুক্ত করা হয়েছে গঠনতন্ত্রে।

২০১২ সালে নেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে চীনে ক্ষমতা দৃঢ়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে সি চিন পিংয়ের। পার্টির গঠনতন্ত্রে সি চিন পিংয়ের ভাবনা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে চীনের এই প্রেসিডেন্ট যদি এখন কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তাহলে তা কমিউনিস্ট পার্টির শাসনের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হবে।

গঠনতন্ত্রে সি চিন পিংয়ের নাম যুক্ত করার ফলে ২০২২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ‘শীর্ষ নেতা’ হিসেবেই থাকবেন তিনি। কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসকে চীনের রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বলে মনে করা হয়। রাজধানী বেইজিংয়ে গত ১৮ অক্টোবর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম জাতীয় কংগ্রেস শুরু হয়। সপ্তাহব্যাপী কংগ্রেসটির মঙ্গলবার ছিল সমাপনী দিন।

বিবিসির খবরে বলা হয়, বেইজিংয়ের গ্রেট হলে কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে দুই হাজারের বেশি প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সংবিধানে ‘নতুন যুগে সি চিন পিংয়ের চীনা সমাজতান্ত্রিক চিন্তা’ অন্তর্ভুক্তির জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। কংগ্রেসের সব প্রক্রিয়া শেষের পর প্রতিনিধিদের জিজ্ঞাসা করা হয়, এ ব্যাপারে তাঁদের কোনো আপত্তি আছে কি না? বেইজিংয়ের গ্রেট হল থেকে সাংবাদিকেরা বলছেন, এ সময় উচ্চস্বরে শোনা যায় ‘না’। এর আগে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের মতাদর্শ কিংবা চিন্তাভাবনা দলীয় সংবিধানে জায়গা পেয়েছে। কিন্তু একমাত্র মাও সে-তুংয়ের ‘চিন্তা’ চীনা সমাজতন্ত্রের দর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়; যা এখন পর্যন্ত দেশটির সমাজতন্ত্রের শীর্ষ আদর্শের জায়গায় আছে।

দলীয় মতাদর্শে শুধু মাও সে-তুং এবং দেং জিয়াও পিংয়ের নাম রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আধুনিক চীনের রূপকার মাও সে-তুংয়ের পরে উঠে এল সি চিনের নাম। সংবিধানে দেংয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাঁর মৃত্যুর পর। চীনের নতুন স্লোগান মানুষের মুখে খুব কমই ঘুরছে। কিন্তু স্কুল শিশু, কলেজ শিক্ষার্থী ও সরকারি কারখানার শ্রমিকেরা এখন থেকে নয় কোটি কমিউনিস্ট পার্টির সদ্যস্যের তালিকায় যোগ দেবে। দলীয় সব সদস্যকেই এখন থেকে চীনা বৈশিষ্ট্যে সমাজতন্ত্রের নতুন যুগে সি চিন পিংয়ের ভাবনা পাঠ করতে হবে।

৬৪ বছর বয়সী সি চিন পিং প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী বলে খ্যাত; চীনা কমিউনিস্ট পার্টির তিনিই আবার সর্বেসর্বা। অবশ্য এককালে পৃথিবীর সব কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সম্পর্কেই এ কথা শোনা যেত। কিন্তু বলা হচ্ছে, সি চিন পিং এসেছেন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে নিজের ব্যক্তিত্ব ও বিশেষত্বের স্বাক্ষর রেখে যাওয়ার জন্য। ২০১২ সালের কংগ্রেসে পার্টির সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার পর থেকে তিনি পার্টির নেতাদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অব্যবহারের বিরুদ্ধে রীতিমতো এক অভিযান শুরু করেছেন। এ ধরনের পদক্ষেপ সাধারণত নানা রকমের বাধার মুখোমুখি হয়, কিন্তু সি চিন পিং সেসব বাধা অগ্রাহ্য করে পার্টির ভেতরে শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন এবং নিজের কর্তৃত্ব অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সংহত করেছেন। কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় তিনি কর্তৃত্ব ও জনপ্রিয়তার মধ্য গগনে অবস্থান করছেন।

পার্টির কংগ্রেস শুরুর দিনে সি চিন পিং তাঁর সুদীর্ঘ প্রতিবেদনের শুরুতেই বলেছেন, চীনা সমাজতন্ত্র এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে, এটা ‘চীনের অগ্রগতির এক নতুন ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ’। এই নতুন যুগে চীনের লক্ষ্য একটি ‘মহান আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশ’ গড়ে তোলা। এটা হবে এমন এক যুগ, যখন চীন মধ্যমঞ্চের কাছাকাছি এগিয়ে যাবে এবং মানবজাতির জন্য আরও বড় অবদান রাখবে। সি বলেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকার ‘মহান আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশ’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০২০ সালের মধ্যে সব ক্ষেত্রে ‘মাঝারি শ্রেণির সমৃদ্ধ সমাজ’ হিসেবে আবির্ভূত হবে এবং তারপর দুই ধাপে লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যাবে। ২০২০ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে সমাজতন্ত্রের আধুনিকায়ন সম্পন্ন করা হবে এবং ২০৩৫ থেকে একুশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ চীন একটি ‘গ্রেট মডার্ন সোশ্যালিস্ট কান্ট্রি’ হয়ে উঠবে। সেই ‘আধুনিক সমাজতান্ত্রিক’ চীন হবে ‘সমৃদ্ধ, শক্তিশালী, গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিকভাবে অগ্রসর, সম্প্রীতিপূর্ণ ও সুন্দর’।

১৯৭৮ সালে বাজার অর্থনীতি ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বানের নীতি গ্রহণের পর থেকে চীনে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু এখনো এই দেশের ৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। দারিদ্র্যসীমার ওপরেও বিপুলসংখ্যক মানুষের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল নয়। অন্যদিকে অল্পসংখ্যক ধনী মানুষের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে। ধনী-দরিদ্রের এই বৈষম্য পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য, সমাজতান্ত্রিক সমাজের নয়। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এই দিকে আগে কতটা দৃষ্টি দিত, তা জানি না, তবে এখন তারা এ বিষয়ে কথা বলছে। সি চিন পিং তাঁর বক্তৃতায় গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, গত পাঁচ বছরে চীনে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে দারিদ্র্য কমেছে: এই সময়ের মধ্যে ছয় কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে এসেছে। পাঁচ বছর আগে চীনের ১০ শতাংশ মানুষ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে, এখন এই হার কমে ৪ শতাংশে নেমেছে। দারিদ্র্য কমার একটা কারণ হলো দ্রুত নগরায়ণ, গত পাঁচ বছরে আট কোটি মানুষ গ্রাম থেকে শহরে এসে স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছে।