ইইউ পার্লামেন্ট 'যৌন হয়রানির আখড়া'!

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পার্লামেন্ট
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পার্লামেন্ট

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পার্লামেন্টের পুরুষ সদস্যদের কাছে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পুরুষ সাংসদদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন বেশ কয়েকজন নারী। তাঁদের একজন বলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্ট যেন ‘যৌন হয়রানির আখড়া’ হয়ে উঠেছে।

চলচ্চিত্র প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টিনের যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর এ খবর প্রচারিত হলো। হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির কথা নারীরা অকপটে বলতে থাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের নারী কর্মীরা যৌন হয়রানির ঘটনা প্রকাশ করলেন।

দ্য টাইমস, দ্য সান ও দ্য সানডে টাইমস ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে নারীদের যৌন হয়রানি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, পার্লামেন্ট সদস্যরা কৌশলে অধস্তন নারী সহকর্মীদের শরীরে, বুকে, পিঠে ও পেছনে হাত দেন। সাংসদেরা প্রভাবশালী হওয়ায় এবং চাকরি যাওয়ার ভয়ে হয়রানির শিকার নারীরা মুখ বুজে সব সহ্য করেন।

ইইউ পার্লামেন্টের চাকরি করা হয়রানির শিকার এক নারী বলেন, ‘৬০ বছর বয়সী একজন পার্লামেন্ট সদস্য আমাকে একা পেয়ে লিফটে উঠে পড়েন। কিন্তু এরপরই তিনি আমাকে ছোঁয়া শুরু করলেন। আমার কানে ফিসফিস করে কথা বলেন।’

ওই নারী বলেন, ‘তিনি আমার চুলে হাত বোলানো শুরু করেন। এরপর আমার ঘাড়, আমার পিঠে। আমি আতঙ্কে ঠান্ডা হয়ে গেলাম। ওই সময় আমার রীতিমতো শক্তি হরণ হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। ঘটনাটি আমার সহকর্মীকে বলেছি। তিনি আমাকে বললেন, এটা নিয়ে অভিযোগ জানানো উচিত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি তা করিনি। চাকরি হারানোর ভয়, অস্বস্তি এবং কর্মজীবন শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল আমার।’

দুই সন্তানের বাবা ওই ব্যক্তি এখনো ইইউ পার্লামেন্টের সদস্য। তাঁর লালসার শিকার শুধু ওই নারী হয়েছেন, এমন নয়; এক ডজনের বেশি অধীনস্থ নারী কর্মী ওই ব্যক্তির কাছে হয়রানির শিকার হয়েছেন।

হয়রানির কিছু কিছু ঘটনা ছিল ভয়ংকর। এক সদস্য তাঁর অধীনস্থ এক নারীর কর্মীর সামনেই হস্তমৈথুন শুরু করেন বলে অভিযোগ আছে।

জার্মানির একজন পার্লামেন্ট সদস্য তাঁর ২২ বছর বয়সী এক নারী সহকারীকে রাজনীতিবিষয়ক একটি কর্মপরিবেশের জন্য দুপুরের খাবারের আমন্ত্রণ জানান। সেখানে ওই নারীকে স্পর্শ করেন তিনি। ২২ বছর বয়সী ওই নারী বলেন, ‘আমরা দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে ছিলাম। তিনি আমার পেছনের দিকে হাত দেওয়া শুরু করেন। ওই মুহূর্তে কী করতে হবে, কোনো ধারণাই ছিল না। আমি তখন বলেছিলাম, “ও খোদা, এটা কি সত্যিই ঘটে গেল?”’ ওই নারী আরও বলেন, ‘আমি আমার বসের সঙ্গে ঝামেলায় যেতে চাইনি। আমি বয়সে খুব ছোট ছিলাম। এমন পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়, তা জানতাম না এবং সে সম্পর্কে খুব সচেতনও ছিলাম না।’ তিনি বলেন, ‘ওই সাংসদ জানতেন যে আমি লজ্জা পেয়েছিলাম এবং শান্ত ছিলাম। তিনি একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। তিনি বেপরোয়া ছিলেন। স্পষ্টভাবে জানতেন যে তিনি এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন এবং এ জন্যই তিনি আমার সামনে খুব আরামেই বসে ছিলেন।’

২২ বছর বয়সী ওই নারীর দাবি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট একটি ‘যৌন নির্যাতনের আখড়া’। কারণ, পার্লামেন্ট সদস্যরা ইচ্ছা করেই তরুণীদের অধস্তন সহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়। তাঁদের ভাবনাটাই এমন যে তাঁরা (পার্লামেন্ট সদস্যরা) কারও কাছে ‘দায়বদ্ধ নন’। পার্লামেন্ট সদস্যর হাতে যৌন হয়রানির শিকার অপর এক জুনিয়র অধস্তন কর্মীর অভিযোগ আরও ভয়াবহ।

২৪ বছর বয়সী অপর এক নারীও এমন ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। তিনি দাবি করেন, কনফারেন্স কক্ষে যাওয়ার পথে তাঁর পথরোধ করা হয়। ওই পার্লামেন্ট সদস্য তাঁর বুকে হাত দেন। পানীয় পানের প্রস্তাবও দেন। ওই নারী মুচকি হেসে সেখান থেকে চলে যান।

দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের লিবারেল ডেমোক্র্যাট থেকে পার্লামেন্ট সদস্য ক্যাথরিন বেয়ার্ডার ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের যৌন হয়রানিবিরোধী কমিটির একজন সদস্য। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারটি শোনা এবং এটা নিয়ে কথা বলা খুব কঠিন কাজ। কারণ, বন্ধ অফিস কক্ষের ঘটনার অভিযোগের কথা শোনা বেশ কঠিন। কেউ যখন আপনার চেয়ে ক্ষমতাশালী হন, তখন ভাবেন যে আপনি সুন্দরী ও আত্মবিশ্বাসী হলেও আর্থিকভাবে এবং অন্যান্য পরিস্থিতির কারণে তাঁরা তা পেরিয়ে যাবেন। সদস্যরা রাজনৈতিকভাবে অনেক ক্ষমতাশালী এবং তাঁরা কখনো কখনো অনুপযুক্ত কাজ করছেন।’

এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য ইইউ পার্লামেন্টের কাঠামোকে দায়ী করে নির্যাতনের শিকার নারীরা জানান, ঘৃণ্য উদ্দেশ্য নিয়েই সুন্দরী নারীদের সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের সাংসদেরা। এরপর নানা ছলে তাঁদের শরীরে হাত দেওয়া থেকে শুরু করে জোর করে বাধ্য করা হয়। চাকরি হারানোর ভয়ে অনেকেই মুখ বুজে সহ্য করেন। তাই অবাধে চলছে এসব ঘটনা। এসব বিষয়ে অভিযোগ করলেও প্রশাসনিক জটে তা আটকেও থাকে। ফলে ন্যায্য বিচার পাওয়ার পথও কার্যত বন্ধ। অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রভাব বিস্তার করে এসব মামলা ধামাচাপা দিয়ে দেন। এমন পরিস্থিতিতে অভিযোগ জানানোর সাহস হারিয়ে ফেলছেন অনেকে। অনেক সময় অপর পুরুষ সহকর্মীরাও বিষয়টি জানার পর মুখ বুজে থাকতে বাধ্য হন।