রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে

রোহিঙ্গা প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করবে, দুই সপ্তাহ ধরে এমন জল্পনাকল্পনা ছিল। কিন্তু গত সোমবার এক আকস্মিক বৈঠকে প্রস্তাব গ্রহণের পরিবর্তে পরিষদের সভাপতি ইতালির স্থায়ী প্রতিনিধির দেওয়া বিবৃতি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। কোনো প্রস্তাব গ্রহণের পথ বন্ধ না হলেও নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার নিয়ে আপাতত এটাই সিদ্ধান্ত।
এই বিবৃতিতে নিরাপত্তা পরিষদ রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হামলার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) নিন্দার পাশাপাশি সেখানে ব্যাপক সন্ত্রাসের ঘটনার ফলে ৬ লাখ ৭ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নাগরিক গৃহচ্যুত হওয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে দায়ী করে কঠোর নিন্দা জানানো হয়েছে। মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায়ও পরিষদ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। রাখাইন রাজ্যে এরপর যাতে আর অতিরিক্ত সামরিক শক্তি প্রয়োগ না করা হয় সে জন্য পরিষদ মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামরিক তৎপরতার ফলে রাখাইন রাজ্যে যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে, সে ব্যাপারে দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণ মতৈক্য রয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কর্তৃক প্রস্তাবিত ফর্মুলা অনুযায়ী এই ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা বন্ধ, উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ প্রেরণ এবং বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা কমিশন যে সুপারিশ করেছে, তার পূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে পূর্ণ মতৈক্য রয়েছে। সোমবার নিরাপত্তা পরিষদ সভাপতির বিবৃতিতে এই সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের ওপর নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
তার নাগরিকদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদানে প্রাথমিক দায়িত্ব মিয়ানমার সরকারের, পরিষদ সভাপতির এই বক্তব্য মিয়ানমার সরকারের মোটেই মনঃপূত হয়নি। পরিষদে তাঁর বক্তব্যে মিয়ানমারের প্রতিনিধি বলেন, সভাপতির বিবৃতিতে মিয়ানমারের ওপর যে ‘অতিরিক্ত চাপ’ প্রয়োগ করা হয়েছে তা সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে না। রাখাইন আরসার সন্ত্রাসী হামলার ফলেই চলতি দুর্যোগের উদ্ভব। তাঁর দাবি, ওই সব বিদ্রোহীর সঙ্গে বিদেশি জঙ্গিরাও হাত মিলিয়েছে, যাদের মধ্যে বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি জঙ্গিরাও রয়েছে। শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে নীতিগত মতৈক্য অর্জিত হলে দুই দেশের সরকার একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করবে, তারপরই শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর কাজ শুরু হবে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন তাঁর বক্তব্যে পরিষদ সভাপতির বিবৃতির জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এই বিবৃতির ভিত্তিতে সংকট সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব, তবে যা করার দ্রুত করতে হবে। তিনি সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত অংশগ্রহণের ওপর জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ তার পক্ষে সম্ভব সবকিছু করতে প্রস্তুত, কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষত নিরাপত্তা পরিষদ যদি তাদের ভূমিকা পালন না করে, তাহলে অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হবে না।
মাসুদ বিন মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবই আমাদের কাম্য ছিল। তবে সভাপতির বিবৃতিটি পাঠ করলে বোঝা যায় এর ভাষা বহুলাংশে পরিষদের প্রস্তাবের মতো। এতে বাংলাদেশের অবস্থানের প্রতিফলন রয়েছে। বাংলাদেশ যে রোহিঙ্গা প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত অংশগ্রহণের আহ্বান করেছে, পরিষদের একাধিক সদস্য তাকে স্বাগত জানিয়েছে।