নিঃসঙ্গ এক রাজকুমারের গল্প

নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের উত্তরসূরি রাজকুমার আলী রাজা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের উত্তরসূরি রাজকুমার আলী রাজা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

একসময়ের রংমহল, নাচ-গান আর আমোদ-ফুর্তির বাকি কিছুই নেই। অতীতের শানশওকত ও জৌলুশও মিশে গেছে সেই অতীতেই। তবু নাম ছিল অবধের নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের। এই নামটুকুই জানতেন মানুষ। জানতেন বিরিয়ানির কথাও। কারণ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চুক্তি ভঙ্গ করায় সিপাহী বিদ্রোহের পর অবধ থেকে পালিয়ে পরিবার নিয়ে কলকাতায় চলে আসে এই নবাবপরিবার। সঙ্গে নিয়ে আসেন বিরিয়ানি খাওয়ার চল। সেই থেকে কলকাতায় বিরিয়ানি জনপ্রিয়তা পায়। অবধের নবাবরা পারস্যের নিশাপুরের রাজবংশের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। ১৭২৪ সালে নবাব সাদাত আলী খান অবধ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ফৈজাবাদ ছিল অবধের রাজধানী। অবধ এখন উত্তর প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত।

নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের উত্তরসূরি রাজকুমার আলী রাজা, যিনি প্রিন্স সাইরাস নামেও পরিচিত ছিলেন। দিল্লির একটি বাড়িতে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতেন তিনি। কারও সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, এমনকি কথাও বলতেন না। চরম দরিদ্র অবস্থায় দিন কাটাতে হয়েছে এই রাজকুমারকে। একসময় যাদের পাশে অনেক দাসী-বাঁদি থাকতেন, সেই রাজকুমার পরে এমনই একা থেকেছেন যে মৃত্যুর সময়টাতেও তাঁর পাশে কেউ ছিলেন না।

গত ২ সেপ্টেম্বর দিল্লির মালচা মার্গের বাসিন্দা আলী রাজার মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। প্রায় ভেঙে পড়া ওই প্রাসাদ থেকে রাজকুমারের লাশ উদ্ধারের সময় অন্য কোনো বাসিন্দা ছিলেন না। সেখানে কেউ আর থাকতেন না আসলে।

দিল্লির মালচা মার্গ। এখানেই থাকতেন আলী রাজা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
দিল্লির মালচা মার্গ। এখানেই থাকতেন আলী রাজা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের চুক্তি ভঙ্গ করায় জৌলুশ হারায় নবাবপরিবার। প্রাসাদ ছেড়ে পালাতে হয় তাদের। জৌলুশ থাকলে হয়তো পরবর্তী নবাব হতেন এই প্রিন্স সাইরাস ওরফে আলী রাজা। ভাগ্য সহায় না হলেও তাঁদের আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রবল। এ কারণে সত্তরের দশকে আলী রাজা, বোন সাকিনা ও মা বেগম ওয়ালিয়াত মহল পত্রিকার শিরোনামে আসেন। তাঁরা নিজেদের ১৮৫৬ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা নির্বাসিত লক্ষ্ণৌয়ের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের বংশধর বলে দাবি করেন। তাঁদের দাবি, বেগম ওয়ালিয়াত মহল নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের প্রপৌত্রী। ব্রিটিশ সরকার তাঁদের সম্পত্তি দখল করায় তাঁরা ভারত সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাসস্থানের দাবি করেন। এই দাবিতে তাঁরা দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনের প্রথম শ্রেণির একটি ওয়েটিংরুমে থাকার বন্দোবস্ত করেন। সেখানে বেগম ওয়ালিয়াত মহল ছেলে আলী রাজা ও মেয়ে সাকিনাকে নিয়ে থাকা শুরু করেন। নিরাপত্তার জন্য তাঁদের সঙ্গে ছিল ১৫টি হিংস্র কুকুর ও সাতজন নেপালি পরিচারক। এ ছাড়া সংগ্রহে থাকা বিপুল পরিমাণ পার্সিয়ান কার্পেটও তাঁরা সঙ্গে রেখেছিলেন।

তৎকালীন ভারত সরকার ১৯৭৭ সালে বেগম ওয়ালিয়াত মহল ও তাঁর সন্তানদের জন্য লক্ষ্ণৌয়ের আলীগঞ্জে একটি বাড়ির ব্যবস্থা করেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রাজন কাশ্যপ এ–সংক্রান্ত একটি চিঠি ১৯৭৭ সালের ১৮ জুলাই পাস করিয়ে নেন। কিন্তু বেগম ওয়ালিয়াত মহল তাতে রাজি হননি। তিনি জানিয়েছিলেন, দিল্লিতেই কোনো প্রাসাদের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তিনি রেলস্টেশন ছাড়বেন না। তা না হলে তিনি বিষপান করে আত্মহত্যা করারও হুমকি দিয়েছিলেন।

আলী রাজার মা বেগম ওয়ালিয়াত মহল। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
আলী রাজার মা বেগম ওয়ালিয়াত মহল। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

লুট্যেনস দিল্লির মালচা মার্গের বাসিন্দা অনিল চন্দ্র বলেন, বেগম ওয়ালিয়াত মহল আসলে দ্বিতীয়বার লক্ষ্ণৌ ফিরে যেতে চাননি। এ কারণেই তিনি দিল্লিতে বিকল্প প্রাসাদের দাবি করেছিলেন।

পরে বাধ্য হয়ে ১৯৮৫ সালে লুট্যেনস দিল্লি এলাকায় বেগম ওয়ালিয়াত মহল ও তাঁর সন্তানদের জন্য একটি প্রাসাদ নির্বাচন করেন সরকার। প্রাসাদটি ছিল ১৪ শতকে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের তৈরি করা একটি ‘শিকারগড়’। যা পরে মালচা মহল বা মালচা মার্গ নামে পরিচিতি পায়। অতঃপর রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে হাড় জিরজিরে ওই প্রাসাদেই থাকা শুরু করেন নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের শেষ বংশধরেরা।

রাজধানী নয়াদিল্লির কাছেই লুট্যেনস দিল্লি এলাকার অবস্থান। ব্রিটিশ স্থপতি এডউইন লুট্যেনসের নামানুসারে এই এলাকার নামকরণ হয়। ভারত যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল তখন অসংখ্য ভবন এডউইন লুট্যেনসের নকশা অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছিল।

আলী রাজার সংগ্রহে থাকা পার্সিয়ান কার্পেট। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
আলী রাজার সংগ্রহে থাকা পার্সিয়ান কার্পেট। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

মালচা মার্গে বসবাসের শুরু থেকেই তাঁরা কারও সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেননি। প্রাসাদ থেকে বাইরে তেমন কোথাও যেতেন না। সব সময় প্রাসাদে হিংস্র কুকুরের প্রহরা থাকত বলে কেউ-ও ওই প্রাসাদে ঢুঁ মারতেন না। তবে ওই প্রাসাদে কোনো বিদ্যুৎ ও পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা ছিল না। কোনো দরজা-জানালাও ছিল না। ওই প্রাসাদ যেন এক বিশাল খোলা খিলান ছিল শুধু। পানির লাইন সংস্কার ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে বেশ কয়েকবার চিঠিও লিখেছিলেন তাঁরা। সেগুলো সংস্কার হয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি।

প্রিন্স আলী রাজার লেখা একটি চিঠিতে জানা গেছে, তাঁরা মালচা মার্গ প্রাসাদে চার পায়া খাটিয়ায় ঘুমান। এভাবেই জৌলুসহীন ভাবে জীবন কাটিয়েছেন নবাব পরিবারের মানুষ।

ভারত সরকারকে দেওয়া আত্মহত্যার হুমকি এক সময় বাস্তবে রূপ নেয়। ১৯৯৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নানা যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে বেগম ওয়ালিয়াত মহল আত্মহত্যা করেন। এরপর থেকেই আলী রাজা ও সাকিনা চরম বিষণ্নতার মধ্যে পড়ে যান। এর চার বছর পর ১৯৯৭ সালে সাকিনা মারা যান। নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন আলী রাজা। জানা গেছে, ওই ভাঙা প্রাসাদে মাঝে মাঝে আসা বিদেশি পত্রিকার প্রতিনিধি ছাড়া তিনি আর কারও সঙ্গে দেখা করতেন না।

১৪ শতকে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের তৈরি মালচা মার্গের এই জীর্ণ ভবনেই বাস করছিলেন বেগম ওয়ালিয়াত মহল ও তাঁর সন্তানেরা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
১৪ শতকে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের তৈরি মালচা মার্গের এই জীর্ণ ভবনেই বাস করছিলেন বেগম ওয়ালিয়াত মহল ও তাঁর সন্তানেরা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

মালচা মার্গের পাশে থাকা ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের (আইএসআরও) একটি স্টেশনের প্রহরী বলেন, ‘মালচা মার্গে পুলিশেরও প্রবেশ নিষেধ ছিল। শুরুতে তাঁর (আলী রাজা) অনেকগুলো কুকুর দেখেছিলাম। কিন্তু গত এক বছর ধরে শুধু একটি কুকুর চোখে পড়েছে।’ তিনি বলেন, তিনি মাঝেমধ্যে প্রধান সড়কে রাজাকে দেখতেন। কিন্তু কোনো দিনও তাঁকে কোনো জিনিসপত্র তাঁকে কিনে নিয়ে যাওয়া দেখেননি। কেউ জানতেন না, রাজা কীভাবে বেঁচে আছেন।

বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি জাস্টিন রোলাট প্রায় সময় মালচা মার্গে গিয়ে আলী রাজার সঙ্গে দেখা করতেন। সাকিনা মারা যাওয়ার বেশ কয়েক মাস পরেই তিনি প্রথমবারের মতো ওই প্রাসাদে যান। তিনি বলেন, ভাইবোন হলে আলী রাজার সঙ্গে সাকিনার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে ছোট্ট ঢিবির ওপর দিয়ে মালচা মার্গে পৌঁছাতে হতো। প্রাসাদের দেয়াল ছিল একদম পলেস্তারা খসা।

পোষা কুকুর নিয়ে আলী রাজা ও তাঁর বোন সাকিনা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
পোষা কুকুর নিয়ে আলী রাজা ও তাঁর বোন সাকিনা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

জাস্টিন রোলাট বলেন, প্রিন্স সাইরাস (আলী রাজা) একবার অভিযোগ করেছিলেন, বৃষ্টির পানি ছাদ চুয়ে পড়ে। মাকড়সার জালে ভরে গেছে ঘর। রাতে জঙ্গলের মধ্য থেকে শিয়াল হাঁক দিয়ে ওঠে। এ রকম চরম দুর্দশার মধ্য দিয়ে গত কয়েক বছর তিনি কাটিয়েছেন। তিনি ছাড়াও আলী রাজার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন নিউইয়র্ক টাইমসের ব্যুরোপ্রধান। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসের ব্যুরোপ্রধান ও জাস্টিন দিল্লির বাইরে থাকায় কয়েক মাস আলী রাজার সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়নি।

আলী রাজার মৃত্যুর পর মালচা মার্গের দশা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
আলী রাজার মৃত্যুর পর মালচা মার্গের দশা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

জাস্টিন রোলাট বলেন, ‘দিল্লি ফিরেই মালচা মার্গে গিয়েছিলাম। প্রিন্সের নাম ধরে ডাকার পর সেদিন পুরো প্রাসাদে যেন নীরবতা বিরাজ করছিল। মনে হচ্ছিল পুরো প্রাসাদে কেউ তল্লাশি চালিয়েছে। মেঝেতে বেশ কিছু চিঠি ও ভিজিটিং কার্ড পড়ে আছে। যার সবগুলোই সাংবাদিকদের রেখে যাওয়া। পরে খবর পাই, এক মাস আগে এই প্রসাদ থেকে আলী রাজার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

আলী রাজার মা বেগম ওয়ালিয়াত মহলের প্রিয় খাবার টেবিল অযত্নে পড়ে আছে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
আলী রাজার মা বেগম ওয়ালিয়াত মহলের প্রিয় খাবার টেবিল অযত্নে পড়ে আছে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের শেষ বংশধর রাজকুমার আলী রাজাকে দিল্লি গেটের কাছে একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাঁকে জানানো হয়নি কোনো সম্মান। ওয়াক্ফ বোর্ডের আর্থিক সহায়তায় নবাবপরিবারের এই উত্তরসূরির দাফন সম্পন্ন হয়।

—বিবিসি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া ডটকম ও উইকিপিডিয়া অবলম্বনে আবু হেনা মোস্তফা কামাল