'মাসিক ঈশ্বরের উপহার'

মাসিক নিয়ে কথা বলার ট্যাবু ভাঙতে সহায়তা করে মেয়েদের ক্লাব। ছবি: এএফপি
মাসিক নিয়ে কথা বলার ট্যাবু ভাঙতে সহায়তা করে মেয়েদের ক্লাব। ছবি: এএফপি

স্কুলের একটি শ্রেণিকক্ষের দরজার ওপরে লেখা ‘মাসিক ঈশ্বরের উপহার’। কক্ষে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে থাকলেও শিক্ষার্থীদের কাছে এটি মেয়েদের ক্লাব নামে পরিচিত। সেখানে তাদের শেখানো হয় মাসিক কী।

ইথিওপিয়ার সমাজে যেখানে প্রকাশ্যে মেয়েদের ঋতুচক্র নিয়ে কথা বলা নিষিদ্ধ, সেখানে শ্রেণিকক্ষে এ নিয়ে পাঠদান! হ্যাঁ, সমাজের এই ট্যাবু ভেঙে দিয়েছে ইথিওপিয়ার মধ্যাঞ্চলের শেনো শহরে এই স্কুল। অন্য সব স্কুল থেকে এটি আলাদা।

মাসিক কী, মাসিক হলে কী করতে হবে, তা না বোঝার কারণে বয়ঃসন্ধিকালে অনেক কিশোরী স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। আর তা ঠেকাতেই এ উদ্যোগ।

জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্যমতে, মাত্র ৫৪ শতাংশ মেয়েশিশু তাদের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে। অনেকে মাসিকের সময় তলপেটে ব্যথার কারণে বা লজ্জায় স্কুল ছেড়ে দেয়।

১৪ বছরের ইয়োরদানোস তেসফায়ের প্রথম যখন মাসিক হলো, তখন সে অনেক হতাশ ও ভয় পেয়েছিল। এএফপিকে সে বলে, ‘আমি বাড়িতে গিয়ে বাবাকে বিষয়টি বললাম। কিন্তু বাবার প্যাড কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তারপর আমি আমার এক বান্ধবীকে বলি, সে আমাকে ন্যাকড়া ব্যবহার করতে বলে। কিন্তু আমি জানতাম না যে এটা কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। একদিন রাস্তাতেই ন্যাকড়াটা খুলে পড়ল। আমি খুব লজ্জা পেয়েছিলাম।’

তেসফায়ের মতো অনেক কিশোরী এই কারণে স্কুল ছাড়তে চেয়েছিল। কিন্তু মেয়েদের ক্লাব তাদের তা করতে দেয়নি।

এই ক্লাবের নাম কাগজে-কলমে ‘মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা’। ইউনিসেফ ও স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সহায়তায় এই ক্লাবে ১১ বছর থেকে শুরু করে বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদের ধারণা দেওয়া হয়। ৬৫টি স্কুলে এ কর্মসূচি পালন করছে সংস্থাটি।

মেয়ে-ছেলে সবাইকে শেখানো হয় মাসিক কী। ছবি: এএফপি
মেয়ে-ছেলে সবাইকে শেখানো হয় মাসিক কী। ছবি: এএফপি

ইথিওপিয়ার ইউনিসেফের স্যানিটেশন-প্রধান স্যামুয়েল গডফ্রে বলেন, ওই সময়ে মেয়েরা খুব জটিল অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। ওই অবস্থায় নিজেকে সামলে নিয়ে ভালো করে পড়াশোনা চালানো তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।

ইথিওপিয়ায় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের বয়স সাধারণত ৭ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে কেউ দেরিতে ভর্তি হলে বা একই ক্লাসে কয়েকবার থাকলে তাদের বয়সটা বেড়ে যায়।

রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে ৫০ মাইল দূরে শেনোর এই স্কুলে ৭৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। সেখানে এখন স্যানিটারি প্যাড বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। মাসিক বিষয়টিকে সহজ করে তুলতে মেয়ে-ছেলে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

ছেলেদেরও এই ক্লাবে নেওয়ার কারণ হলো মাসিক নিয়ে ছেলেরা মেয়েদের খ্যাপাত। যেমন বলত, ‘দেখ, তোর জামার পেছনে রক্তের দাগ।’ আর এটা শোনার পর মেয়েরা বারবার তার জামা দেখত। এসব থেকে বাঁচাতে ছেলেদেরও বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। ১৪ বছরের ইউনুস নেগোসি জানায়, এই ক্লাবের মাধ্যমে বিষয়টি জানার পর সে তার বোনকে প্যাড কিনে দিয়েছে।

শ্রেণিকক্ষে মাসিকের সময় কীভাবে নিজেকে সামলে নিতে হবে, সেই শিক্ষা দেন শিক্ষক। ছবি: এএফপি
শ্রেণিকক্ষে মাসিকের সময় কীভাবে নিজেকে সামলে নিতে হবে, সেই শিক্ষা দেন শিক্ষক। ছবি: এএফপি

এই ক্লাব খোলার পর তিন বছরে স্কুলটিতে মাসিকের কারণে ঝরে পড়ার হার শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে। অথচ এর আগের বছরও ২০ জন ছাত্রী স্কুল ছেড়েছিল এই কারণে।

স্কুলের বায়োলজি বিষয়ের শিক্ষক টেফসেচ বেলেমি মেয়েদের মধ্যে যাদের প্যাড কেনার ক্ষমতা নেই, তাদের মধ্যে পুনরায় ব্যবহার করা যায়—এমন প্যাড বিতরণ করেন। এমনকি শরীর খারাপ লাগলে তাদের গোসলের ও শোয়ার ব্যবস্থা করেন। এই শিক্ষক বলেন, ‘আমরা এই ক্লাবে শিক্ষার্থীদের বোঝাই, মাসিক হলো ঈশ্বরের দেওয়া এক উপহার। এটা কোনো অসুখ নয়। এটা স্বাভাবিক ও জৈবিক একটি বিষয়।’

টেফসেচ যদি মনে করেন কোনো মেয়ে মাসিকের কারণে স্কুলে আসছে না, তাহলে তিনি তাদের খোঁজে বের করেন। এরপর তিনি ওই মেয়ের পরিবারকে বিষয়টি বোঝান।

ওই এলাকার আরেকটি স্কুলের ১৪ বছরের শিক্ষার্থী হিওত ওয়েরকার ভাষ্য, ক্লাস চলাকালে তার মাসিক হয়েছিল। স্কুলের জামায় রক্তের দাগ লেগে যায়। পাছে কেউ দেখে ফেলে, সে চিন্তায় সারা দিন সে সবার কাছ থেকে দূরে সরে ছিল। এমনকি বিষয়টি জানার পর তার মা বলেছিল, সে যৌন সংসর্গ করেছে। তাই তাকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেন। এরপরও সে স্কুলে যেতে চাওয়ায় তাকে মারধর করেন।

এরপর স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা বিষয়টি জানার পর তাঁরা তার মাকে বিষয়টি বোঝান। বলেন, এটি স্বাভাবিক এবং এর সঙ্গে যৌনতার কোনো সম্পর্ক নেই। একসময় হিওতের মা বিষয়টি বুঝতে পারেন এবং মেয়েকে স্কুলে পাঠান।

মাসিকের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে আফ্রিকার অনেক দেশে কাজ করছে ইউনিসেফ। ২০১৫ সালে জাম্বিয়া এ-সংক্রান্ত এক আইন পাস করে। সেখানে বলা হয়, মাসিকের সময় ব্যথার কারণে কোনো নারী চাইলে বিনা নোটিশে কাজে অনুপস্থিত থাকতে পারেন। এমনকি এ বছরের শুরুর দিকে কেনিয়া সব স্কুলে বিনা মূল্যে মেয়েদের স্যানিটারি প্যাড দেওয়া বাধ্যতামূলক করে।