যে শহরে পড়ে আছে টনের পর টন হীরা!

জার্মানির নয়নাভিরাম নর্দলিনগেন শহর। এখানকার পাথরে রয়েছে লাখ লাখ হিরার মিশ্রণ। ছবি: টুইটার
জার্মানির নয়নাভিরাম নর্দলিনগেন শহর। এখানকার পাথরে রয়েছে লাখ লাখ হিরার মিশ্রণ। ছবি: টুইটার

বাঁ হাতের অনামিকায় হীরার আংটি মানেই তো বিয়ের বাদ্যি বেজে ওঠা। হীরাখচিত গয়নার প্রতি আকর্ষণ অবশ্য এমনিতেও কম নয়। এখন অবশ্য হীরার পোশাকও মেলে। চাই কী, হীরার গ্রহও আছে! দুঃখের বিষয়, পৃথিবী থেকে ৪০ আলোকবর্ষ দূরে বলে সে হিরে জোগাড়ের চেষ্টা আপাতত করা সম্ভব নয়। কিন্তু জানেন কি, এই পৃথিবীতেই এমন একটি শহর আছে, যার পরতে পরতে ছড়িয়ে লাখ লাখ হীরা!

বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে ফেলেছেন? ভালো! সে কর্ম শেষ হলে এবার ঘুরে আসুন জার্মানির নর্দলিনগেন শহর। বিবিসির প্রতিবেদক ম্যাথু ভিকেরি সম্প্রতি নর্দলিনগেন ঘুরে এসে জানিয়েছেন অত্যাশ্চর্য সেই কাহিনি। ব্যাভারিয়া অঞ্চলের প্রাচীন এ শহরে গথিক-স্থাপত্যরীতি মেনে বানানো সেন্ট জর্জেস গির্জা সিঁড়ি ভেঙে টাওয়ারে ওঠার সময় ভিকেরি খেয়াল করেন, সূর্যের আলোয় পাথুরে সিঁড়িগুলো কেমন ঝিক করে উঠছে। যেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।
গির্জাটি বানানোর সময়কাল ১৪২৭-১৫০৫ খ্রিষ্টাব্দ। এত পুরোনো গির্জার সিঁড়ি কালচে-বাদামি রং ধারণ করার কথা, তা না হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে! কারণ ব্যাখ্যা করলেন গির্জার টাওয়ারের রক্ষী হোর্স্ট লেনার, ‘গোটা টাওয়ারটি বানানো হয়েছে সুভাইট পাথর দিয়ে। এর ভেতরে রয়েছে অনেক হীরা। ভাগ্যিস হীরাগুলো অনেক ছোট। তা না হলে এই গির্জা কবেই ভেঙে ফেলা হতো!’
লেনার কৌতুক করলেও কথাটি কিন্তু মিথ্যা নয়। লিখিত ইতিহাস অনুযায়ী নর্দলিনগেনের গোড়াপত্তন নবম শতকে। শহরটি তৈরির সময় সেখানকার স্থানীয় লোকজন জানত না, যে পাথর দিয়ে শহর গড়ছে তারা, তার মধ্যে রয়েছে ছোট ছোট অনেক হীরা। এই পাথর এল কোথা থেকে?
প্রায় দেড় কোটি বছর আগে নর্দলিনগেন অঞ্চলে আছড়ে পড়েছিল এক কিলোমিটার প্রশস্তের একটি গ্রহাণু। সেকেন্ডে ২৫ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানা সেই গ্রহাণু সেখানে ২৬ কিলোমিটার অঞ্চল নিয়ে একটি গর্তের সৃষ্টি করে। আঘাতের চাপে ও তাপে কার্বন রূপান্তরিত হয় ভীষণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হীরকে, যা মরিচের গুঁড়োর মতো মিশে গেছে সুভাইট পাথরের সঙ্গে। হীরাগুলো এতই ছোট যে সবই আকারে ০.২ মিলিমিটারের কম। খালি চোখে দেখা খুব কঠিন।

সেন্ট জর্জেস গির্জার টাওয়ার। ছবি: ট্রাভেল ব্লগ
সেন্ট জর্জেস গির্জার টাওয়ার। ছবি: ট্রাভেল ব্লগ


গ্রহাণুর সেই সুভাইট পাথর দিয়ে বানানো হয়েছে শহরটির বেশির ভাগ বসতবাড়ি। মানে, হীরার বাড়ি, হীরার শহর—এমন জায়গা পৃথিবীতে নেই দ্বিতীয়টি! নর্দলিনগেনের বাসিন্দা রোজউইথা ফেইলের ভাষ্য, ‘এ শহরের মধ্যে যা কিছু দেখছেন, সবই সেই গ্রহাণুর আঘাতের ফলে সৃষ্ট পাথর দিয়ে গড়া।’ অথচ পঞ্চাশ দশক পর্যন্তও এখানকার বাসিন্দারা মনে করতেন, শহরটি কোনো মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের ওপর বানানো হয়েছে। ষাটের দশকে নর্দলিনগেনে ঢুঁ মেরে তাঁদের ভুল ভাঙিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই ভূতত্ত্ববিদ ইউজেনে শুমেকার এবং এডওয়ার্ড চাও। এ দুই ভূতত্ত্ববিদ প্রমাণ করেছিলেন, নর্দলিনগেন আসলে বসে আছে পৃথিবীতে আছড়ে পড়া একটি গ্রহাণুর ওপর!
নর্দলিনগেনের স্থানীয় ভূতাত্ত্বিকদের মতে, এই শহরে প্রায় ৭২ হাজার টন হীরার মজুত আছে। কিন্তু সবই সুভাইট পাথরের মধ্যে মিশ্রিত। সুভাইট পাথর পৃথিবীর আরও বেশ কিছু জায়গায় মিলেছে, একই ঘটনার (গ্রহাণুর আছড়ে পড়া) ফলাফল হিসেবে। কিন্তু সেসব জায়গায় পাথরের মধ্যে ‘জেমস্টোন’(রত্নপাথর)-এর মিশ্রণ নর্দলিনগেনের মতো এত বেশি নয়। এখানকার পাথরের নমুনা দেখতে নর্দলিনগেনে নিয়মিতই পা পড়ে নাসা কিংবা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির মহাকাশচারীদের।
কিন্তু কথা হচ্ছিল হীরা নিয়ে। আশ্চর্য হবেন, শহরের পরতে পরতে হীরা মিশে থাকলেও স্থানীয় লোকদের তা নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। প্রায় প্রতিদিনই পর্যটক, ভূতত্ত্ববিদ কিংবা মহাকাশচারীদের আনাগোনা দেখে অধিবাসীরা আশ্চর্য হন। তাঁদের প্রশ্ন, এখানে এত দেখার কী আছে? নর্দলিনগেনের রাইয়েসক্রাটর জাদুঘরের পরিচালক ডক্টর স্টেফান হোলজের কাছে মিলল সে প্রশ্নের জবাব, ‘এখানকার সবকিছুর সঙ্গে কোটি কোটি বছর আগের ঘটনাপঞ্জির যোগসূত্র রয়েছে। ব্যাপারটা হয়তো অতীত, কিন্তু আপনি এখনো তা দেখতে পাচ্ছেন। এখানকার বর্তমান তো আসলে অতীতেরই ফসল।’ সূত্র: বিবিসি।