হার্দিক প্যাটেলই ভোটযুদ্ধের নায়ক

হার্দিক প্যাটেল
হার্দিক প্যাটেল

একটা ছোট্ট ঘটনা এভাবে যে তাঁর জীবনটাই পাল্টে দেবে, একদা ‘গাঁয়ে চেনে না আপনি মোড়ল’ ছোকরাটা তা স্বপ্নেও ভাবেননি। আজ সেই ছোকরার নাম গুজরাটের আগাপাছতলায় শোনেনি এমন লোকের খোঁজ পাওয়া কঠিনই শুধু নয়, অসম্ভবও। ২৪ বছরের সেই একদা ছোকরা আজ রাজ্যের সমীহ জাগানো নাম। হার্দিক প্যাটেল।
বছর আড়াই আগেও হার্দিক ছিলেন রাম-শ্যাম-যদু-মধুর মতো অজানা-অনামা-অজ্ঞাতকুলশীল এক অতিসাধারণ ‘পাবলিক’। আহমেদাবাদের সাধারণ কলেজ থেকে সাধারণ নম্বর পেয়ে পাস করে কী করি কী করি ভাবনার মাঝে যখন খেই পাচ্ছেন না, যখন ভাবছেন পারিবারিক পানিরপাম্পের ব্যবসাই হয়তো ভবিতব্য, তখনই ছোট্ট একটা ঘটনা জীবনের মোড়টাই পাল্টে দেয়।

হার্দিকের ছোট বোন মনিকা ২০১৫ সালে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হন। একই সঙ্গে তিনি আবেদন করেন সরকারি বৃত্তির। যোগ্যতার মাপকাঠিতে সবকিছু ঠিক থাকলেও সেই আবেদন নাকচ হয়। খোঁজ করতে গিয়ে চোখ খুলে যায় হার্দিকের। বুঝলেন তফসিল জাতি, তফসিল উপজাতি এবং অনগ্রসর ব্যক্তিদের জন্য রাজ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চাকরিতে ৪৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের যে সুবিধা রয়েছে, মনিকা তার থেকে বঞ্চিত। অপরাধ? প্যাটেলরা উচ্চবর্ণের প্রতিনিধি।

জাতিগত অন্যায়-অবিচারের জন্য যে ক্ষোভ ধিকিধিকি জ্বলছিল, ছোট বোন মনিকার অশ্রু ও খেদ তা দাবানলে পরিণত করল। বছর দুয়েক ধরে সেই ক্ষোভ গুজরাটের রাজনৈতিক সমীকরণে নতুন এক বিন্যাস ঘটিয়ে দিয়েছে।

রাজ্যের মোট ভোটারদের মধ্যে প্যাটেলরা ১৪ শতাংশ। এদের দুটি বর্গ লেউয়া ও করোয়া। লেউয়ারা সমৃদ্ধিশালী, রাজনৈতিক প্রতিপত্তিশালী, বড় ব্যবসায়ী, শিল্পদ্যোগী এবং সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তুলনায় করোয়া প্যাটেলরা প্রধানত কৃষিজীবী। রাজ্যের কৃষিভিত্তিক বাণিজ্য তাদেরই দখলে। ছোট বোনের কান্না হার্দিকের শুধু চোখই খুলে দিল না, প্যাটেলদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের দাবিতে শুরু করলেন ক্ষুরধার আন্দোলন। জন্ম দিলেন ‘পাতিদার অনামত আন্দোলন সমিতি’-র, সংক্ষেপে যা গোটা রাজ্যে ‘পাস’ নামে পরিচিতি পেয়ে গেছে। এই ভোটে এই শক্তিকে উপেক্ষা করার মতো বুকের পাটা আজ ভারতের ৫৬ ইঞ্চি ছাতির মালিকেরও নেই।

সংরক্ষণের দাবিতে পাতিদার আন্দোলন দিন দিন তুখোড় হয়ে ওঠে। পুলিশের গুলি চলে, প্রাণহানি ঘটে। রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে বিজেপি সরকার দীর্ঘদিন জেলের কুঠুরিতে বন্দী রাখে হার্দিককে। আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্ত সেই হার্দিক রাজ্য চষে ফেলে বিজেপির বিরুদ্ধে তীব্রতর করে তুলেছেন করোয়া প্যাটেলদের আন্দোলন।

২২ বছর ধরে প্যাটেলরা চোখ বুজে বিজেপিকে সমর্থন করে এসেছে। এবার হার্দিক প্যাটেল সরাসরি সমর্থন জানিয়েছেন কংগ্রেসকে। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁরই মতো গুজরাটের ভূমিপুত্র দল সভাপতি অমিত শাহর ভয়ের কারণ এখানেই। গত রাজ্য বিধানসভার মোট ১৮২ আসনের মধ্যে ১১৬টি দখল নেয় বিজেপি। কংগ্রেসের ভাগে জোটে ৬০টি আসন। ২০১২ সালে বিধানসভার যে ভোটে বিজেপি পঞ্চমবারের জন্য জিতেছিল, তাতে কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের ভোট প্রাপ্তির ফারাক ছিল ৯ শতাংশ। আর ২০১৫ সালে রাজ্যের পঞ্চায়েত, পুরসভা ও করপোরেশনের নির্বাচনে হার্দিকের নেতৃত্বে পাতিদার আন্দোলনের তীব্রতা বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের ভোট প্রাপ্তির ফারাক ৯ থেকে কমিয়ে আনে ৩ শতাংশে। মোট ৬টি করপোরেশনের একটিও কংগ্রেস জেতেনি ঠিকই কিন্তু আগেরবারের তুলনায় আসন বাড়ায় প্রায় ২৫ শতাংশ। তুলনায় বিজেপির মোট আসন ৪৪৩ থেকে কমে হয় ২৭১।

রাজ্যের এ-মাথা থেকে ও-মাথা চষে ফেলে হার্দিক বলছেন, ‘যে বিজেপিকে আমরাই ক্ষমতায় রেখেছি, সেই বিজেপিকেই ক্ষমতাচ্যুত করে দেখিয়ে দেব। আর এ কারণেই বিজেপি মোট ৫২ জন প্যাটেলকে টিকিট দিয়েছে যাদের অধিকাংশই করোয়া প্যাটেল।’ এদিকে নোট বাতিল ও সারা দেশে চালু করা অভিন্ন পণ্য ও পরিষেবা কর, সংক্ষেপে যা ‘জিএসটি’, এবারের গুজরাটের ভোটকে একেবারে সরাসরি মোদি বনাম রাহুলে পরিণত করেছে। আর এই ভোটযুদ্ধের নেপথ্যের নায়ক অবশ্যই ২৪ বছরের আনকোরা হার্দিক প্যাটেল।