'রেড ইউনিট' ভয়ংকর

আফগানিস্তানের পাকতিয়া প্রদেশে তালেবান জঙ্গিদের সশস্ত্র অবস্থান। ছবি: এএফপি
আফগানিস্তানের পাকতিয়া প্রদেশে তালেবান জঙ্গিদের সশস্ত্র অবস্থান। ছবি: এএফপি

ঘোর বিপদে আছে আফগান সরকার। দেশটিতে চলমান তালেবানবিরোধী যুদ্ধ নতুন মোড় নিয়েছে। আর এই যুদ্ধে বিশেষ করে আফগান পুলিশের রক্ত সবচেয়ে বেশি ঝরছে।

অনেকেই ভাবছিল, দীর্ঘদিনের যুদ্ধে তালেবান হয়তো দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাদের ভাবনা ভুল প্রমাণ করে চলছে তালেবান। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন কৌশল নিয়ে হাজির। তালেবানের কৌশলের কাছে আফগান পুলিশের পাশাপাশি সেনারাও মার খাচ্ছে। উদ্বেগ বাড়ছে কাবুলে।

সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জন্য রীতিমতো আতঙ্ক হয়ে উঠেছে ‘রেড ইউনিট’। এটি তালেবানের বিশেষ বাহিনী। এই বাহিনীর তৎপরতা ও কার্যকারিতা খোদ আফগান সরকারই অকপটে স্বীকার করেছে। রেড ইউনিট নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হচ্ছে। তাদের সামরিক কৌশল নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের পর্যন্ত ভাবিয়ে তুলেছে।

নিউজউইক বলছে, রেড ইউনিটের গঠন ও কার্যক্রম দেখলে মনে হয়, তালেবানের এই এলিট ইউনিট যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের বিশেষ বাহিনীর অনুকরণে গড়া।

রেড ইউনিটকে উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি দক্ষ বাহিনী হিসেবে বর্ণনা করেছে রয়টার্স ও দ্য নিউইয়র্ক টাইমস।

২০১৫ সালে তালেবান কিছু ছবি প্রকাশ করে। ছবিতে তাদের যোদ্ধাদের শারীরিক অনুশীলন করতে দেখা যায়। তারা অস্ত্রেরও প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। ছবিগুলো থেকে ধারণা করা হয়, তালেবান একটি এলিট ইউনিট গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে।

আফগান কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, রেড ইউনিটের সদস্যসংখ্যা কয়েক শ হবে। আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে তারা আকস্মিক হামলা চালাচ্ছে। হামলা চালানোর পর তারা দ্রুত অন্যত্র সটকে পড়ছে। তাদের কাছে রাশিয়ায় তৈরি নাইট ভিশন গগলস আছে। আছে ৮২ এমএম রকেট, ভারী মেশিনগান, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি অ্যাসল্ট রাইফেল। রাইফেলের সঙ্গে যুক্ত করা আছে লেজার। লেজারের নিখুঁত নিশানায় ইতিমধ্যে বহু আফগান পুলিশ ও সেনা প্রাণ হারিয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে তালেবানের হামলার ধরন দেখে আফগান কর্তৃপক্ষের মনে হয়েছে, জঙ্গিরা সরকারি বাহিনী বিশেষ করে পুলিশের চেয়ে অধিকতর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। এমনকি তারা সেনা বা পুলিশের গাড়ি চুরি করে তা হামলার কাজে লাগাচ্ছে। তালেবান জঙ্গিদের সঙ্গে পুলিশ পেরে উঠছে না। কারণ, পুলিশের অস্ত্রশস্ত্র ততটা আধুনিক নয়।

রেড ইউনিটের অস্ত্রশস্ত্র বিশ্লেষণ করে আফগানিস্তানের সামরিক কর্মকর্তারা বলছেন, এগুলো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইরান ও পাকিস্তানে তৈরি। উন্নত অস্ত্রশস্ত্রগুলো পাকিস্তানের কালোবাজার থেকে সংগ্রহ করে থাকতে পারে তালেবান। আবার যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত আফগান সেনাদের কাছ থেকেও তারা তা নিতে পারে।

তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদের দাবি, যুদ্ধে পরাজিত সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে তাঁরা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র জব্দ করেছেন। এখন তা সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করছেন।

রেড ইউনিটের আধুনিক সমরাস্ত্রের উৎস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তাদের সন্দেহের তির রাশিয়া ও ইরানের দিকে। পাশাপাশি তালেবানের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পাকিস্তানের নাম তো অনেক আগে থেকেই বলে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।

রেড ইউনিট যে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, তা টের পাওয়া যায় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের কথাবার্তায়। ফারাহ প্রাদেশিক কাউন্সিলের সদস্য দাদুল্লাহ কানি বলেন, ‘পরিস্থিতি শোচনীয়। তালেবান পুরো প্রদেশ দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের হাতে আছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র।’

কান্দাহার প্রদেশের গভর্নরের মুখপাত্র কুদরতুল্লাহ খুশবাকত বলেন, যুদ্ধে তালেবান এখন ভিন্ন কৌশল ব্যবহার করছে। তাদের নিজস্ব ভ্রাম্যমাণ বিশেষ ইউনিট আছে। এই ইউনিটের হাতে রয়েছে লেজার ও নাইট ভিশন প্রযুক্তি। এ দিয়ে তারা রাতের অন্ধকারে দেখতে পায়। তারা হুটহাট তল্লাশিকেন্দ্র ও ঘাঁটিতে হামলা চালাচ্ছে। বিমান হামলা এড়াতে মুহূর্তের মধ্যে এলাকা ছাড়ছে।

হামলার ক্ষেত্রে রেড ইউনিটের নাইট ভিশনসহ বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার প্রসঙ্গে অনেকটা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেজর জেনারেল দৌলত ওয়াজিরি। তিনি দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘শত্রুরা আমাদের দেখতে পারছে। কিন্তু আমরা তাদের দেখতে পারছি না।’

আফগানিস্তানে তালেবান জঙ্গিরা অনেক দিন ধরে আধিপত্য ছড়ানো জঙ্গি ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আফগানিস্তানে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থান ঘটেছে। আইএসের আবির্ভাবে আফগানিস্তানে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তালেবান আধিপত্য। বদলে গেছে আফগান যুদ্ধের হিসাব-নিকাশ। বিশ্লেষকদের ধারণা, আফগান সরকার ও আইএস-উভয় প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতেই তালেবান বিশেষ ইউনিট গঠন করেছে।

তালেবান এলিট বাহিনীর প্রতাপ ও আইএসের প্রভাব বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা বাড়ানোর বিষয়ে মাস কয়েক আগে ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্ত কাবুলের জন্য আপাতত স্বস্তিরই বটে।