মোদিভূমি অচঞ্চল

মইনুদ্দিন আলম বললেন, নিয়ন্ত্রণরেখা শুধু জম্মু-কাশ্মীরেই নয়, এখানেও আছে। এই আহমেদাবাদে। একটা নয়, একাধিক।
দাঁড়িয়ে আছি এ রকমই এক ‘লাইন অব কন্ট্রোল’-এ। একধারে উচ্চকোটির অঢেল বিত্ত ও অফুরন্ত বৈভবের হাজার লক্ষ ভোল্টের চোখধাঁধানো দীপ্তি, অন্যধারে গা-ঘেঁষাঘেঁষি ঘিঞ্জি ঘুণেধরা অনুচ্চ বিনীত অবস্থান। একধারে নরেন্দ্র মোদির ‘ভাইব্রেন্ট গুজরাট’-এর রঙিন ও উজ্জ্বল উপস্থিতি, পরাক্রম ও ঔদ্ধত্যের উচ্চকিত ঘোষণা, অন্যধারে সাদামাটা আটপৌরে অনুজ্জ্বল জীবনযাপনের ম্যাড়মেড়ে চালচিত্র। একটা দিক নরেন্দ্র মোদির স্বপ্ন ও সাধের ‘হিন্দুস্তান’, অন্যধার করুণাশ্রিত অবহেলিত ‘পাকিস্তান’। এপাশে হিন্দু বসতি, ওপাশে মুসলমান। এ যেন সেই সুয়ো ও দুয়োরানির গল্প। মাঝে প্রবাহিত সবরমতী, এই শহরের অন্যতম নিয়ন্ত্রণরেখা।

মইনুদ্দিন আলম বললেন, ‘এটাই আমাদের গণ্ডিকাটা ধর্মনিরপেক্ষতা।’

গতকাল বুধবার দুপুর সাড়ে বারোটা। পঁচিশ বছর আগে এই দিনটায় ঠিক এই সময়ই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছিল তিন গম্বুজঅলা বাবরি মসজিদের প্রথমটা। ইট, চুন, বালু, সুরকির গাঁথুনি শত শত করসেবকের শাবল ও গাঁইতির আঘাত সহ্য করতে পারেনি। পঁচিশ বছর পরের এই দিন আহমেদাবাদের দুপুর সাড়ে বারোটার আকাশ কালো মেঘে মোড়া। সাইক্লোন ‘অক্ষি’র দৌলতে আকাশ দেখে বোঝার উপায় নেই সূর্য মধ্যগগনে এল কি না। কিন্তু তাতে কী? জোহরের নামাজের আজান ভেসে আসছে। কোথাও কোনো অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য নেই। উত্তেজনাও। আজ দেড় দশক ধরে আহমেদাবাদের জীবন এমনই নিস্তরঙ্গ।

মইনুদ্দিন আলম বললেন, ‘আপনি মনে করিয়ে দিলেন তাই। নইলে ভুলেই গিয়েছিলাম আজ ৬ ডিসেম্বর। আজই ধূলিসাৎ হয়েছিল বাবরি মসজিদ।’
লাইন অব কন্ট্রোলের এধারটার নাম নাড়োল। গন্ধা পানির বিশাল যে দিঘি, যার স্থানীয় নাম ‘শাহ আলম কা তালাও’, তারই খানিক তফাতে এই নাড়োল। সেখানেই বদর মসজিদের তলায় শোয়েব মির্জার হরেক কিসিমের পাইপের দোকান ‘লাকি এন্টারপ্রাইজ’। মইনুদ্দিনের মতো তাঁরও চোখেমুখে বিস্ময়! ‘বাবরি মসজিদ ভাঙার পঁচিশ বছর কেটে গেল? ভুলেই গিয়েছিলাম তারিখটা।’

স্বাভাবিক স্মৃতিভ্রম নাকি ইচ্ছাকৃত স্মৃতিলোপ, সেই বিতর্কে ঢুকতে নারাজ এই তল্লাটের জিনসের কারবারি ইমতিয়াজ মালিক। ‘শেষ কবে আহমেদাবাদে দাঙ্গা হয়েছে মনে করতে পারি না। এই আমরা বেশ আছি। ধান্দা চলছে। পেটে দানাপানি আছে। পরিবার খুশি। দাঙ্গা-ফ্যাসাদে মানুষ ধনে মরে, প্রাণেও মরে।’

অথচ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর এমন একটা বছর যায়নি যখন এই দিনটায় বিশেষ প্রার্থনা হয়নি। বদর মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ ধীরে ধীরে এ কথা শুনিয়ে বললেন, ‘তখন ফি-বছর এই দিনে জুলুস (মিছিল) বেরোত। নাড়াবাজি (স্লোগান) হতো। কিন্তু গোধরার পর যে দাঙ্গা গোটা শহরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিল, তারপর থেকে সব চুপচাপ।’ আজ দীর্ঘ পনেরো বছর গুজরাট দাঙ্গাহীন।

দুই দিন পর প্রথম দফার ভোট। অথচ নাড়োলের মতো জুহাপুরা বা জামালপুর এলাকা, স্থানীয় লোকজনের কাছে যা নাকি ‘পাকিস্তান’, কেমন যেন ঝিমিয়ে আছে। প্রার্থীদের পোস্টার কি দলীয় পতাকার চেয়ে বেশি উড়ছে সবুজ, কালো ও লাল রঙের ত্রিকোণ পতাকা। কোনো কোনো পতাকা জরি দিয়ে মোড়া। মইনুদ্দিন আলমের কথায়, ‘এগুলো শান্তির ধ্বজা। ইসলাম শব্দের অর্থ শান্তি। গোটা গুজরাটই আজ বহুদিন শান্তির নীড়।’

এই শান্তি, এই ভক্তির উৎস তা হলে কি ভয়? প্রাণের ভয়, অশান্তির ভয়? রাষ্ট্রের ভয়?
শুধু মইনুদ্দিন নন, ব্যবসায়ী শোয়েব অথবা ইমতিয়াজেরাও স্পিকটি নট। শুধু মুখ খুললেন ইমাম মোহাম্মদ। বললেন, ‘মুসলমান ভয় পায় শুধু আল্লাহ তায়ালাকে। এই সুনসান সান্নাটাভাব অন্য কিছু। একেবারে অন্য রকম।’

কী রকম, সেই হেঁয়ালি স্পষ্ট হলো প্রবীণ কংগ্রেস নেতা হাসমুখভাই প্যাটেলের কথায়। ‘ধর্মীয় মেরুকরণের রাস্তায় আমরা হাঁটতে রাজি নই। বিজেপি ঠিক ওটাই চায়। তাই বারবার প্ররোচিত করে চলেছে।’ গত মঙ্গলবার এই কথাটাই আরও একবার স্থানীয় কংগ্রেস নেতা ও কর্মীদের বুঝিয়ে বলেছেন গুজরাটের ভূমিপুত্র ও ভারুচের ‘বাবুভাই’ সোনিয়া গান্ধীর রাজনৈতিক সচিব আহমেদ প্যাটেল। বলেছেন, বিজেপি চাইছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে কংগ্রেসকে টেনে এনে ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটিয়ে ভোটে জিততে। আমরা সেই ফাঁদে পা দেব না।’

বাবরি-জাতীয় হইচই অথবা গোধরা-জাতীয় অপকর্ম বিজেপির রথ এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে সহায়ক। লাইন অব কন্ট্রোলের অন্যধারের বাসিন্দারা বুঝে গেছেন, তাঁদের যেকোনো আস্ফালন ভিন্ন মেরুকরণের জন্ম দেবে। অতএব অনুচ্চকিত নির্দেশ, ‘চুপচাপ হাতে ছাপ’।
মোদিভূমিতে বাবরি ধ্বংসের সিকি শতক প্রায় অনুচ্চারিতই রয়ে গেল।