ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইন্তিফাদার ডাক হামাসের

হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া। ছবি: এএফপি
হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া। ছবি: এএফপি

জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়ে নতুন করে সহিসংতা উসকে দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর এ ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে উঠেছে নিন্দার ঝড়। এরপরই নতুন ইন্তিফাদার (গণ-অভ্যুত্থান) ডাক দিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী দল হামাস।

এএফপি ও আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের ঘোষণার পর আগামীকাল শুক্রবার জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। কিছুদিন আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে জেরুজালেমে ইসরায়েলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে অবৈধ বলে খসড়া পাস হয়েছিল।

ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স
ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়ে ট্রাম্প পক্ষান্তরে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিনের গাজায় এক বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি নতুন করে ইন্তিফাদার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি শান্তিপ্রক্রিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অসলো চুক্তি এবং পুনর্বাসন-প্রক্রিয়াকে হত্যা করা হয়েছে।

এ বছরের মে মাসে হামাসের প্রধান নির্বাচিত হন ইসমাইল হানিয়া। হানিয়া বলেন, ফিলিস্তিনিরা সম্পূর্ণ জেরুজালেমকে নিজেদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী মনে করেন। তিনি বলেন, ‘ইহুদিবাদী শত্রুদের বিরুদ্ধে ইন্তিফাদা শুরু করতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।’ তিনি বলেছেন, শুক্রবার দিনটি যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে র‍্যালি করুন আপনারা।

ইসমাইল হানিয়ার এ ঘোষণা কিছুক্ষণ পরেই গাজা, পশ্চিম তীরের রামাল্লা, হেবরন ও নাবলুসের রাস্তায় নেমে আসেন বিক্ষোভকারীরা। শুরু হয় ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে ইসরায়েলি সেনারা।

এ দিনটিকে ইসমাইল হানিয়া ‘ক্ষোভ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি ঘোষণায় বলেন, ‘দখলদারদের বিরুদ্ধে ৮ ডিসেম্বর হোক আমাদের ইনতিফাদার প্রথম দিন।’

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামাসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখে থাকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে না হামাস। এ সংগঠনের আত্মঘাতী বোমারুরা ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শেষ ইনতিফাদায় সহায়তা করেছিল। ইসমাইল হানিয়ে বলেন, জেরুজালেম ও ফিলিস্তিনের জন্য হুমকি এমন কৌশলগত কোনো বিপদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য সব হামাস সদস্য ও এর শাখা-প্রশাখাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে নতুন নির্দেশনার জন্য পূর্ণ প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।

জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতির পরই ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স
জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতির পরই ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা ও ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরের দিকে ইঙ্গিত করে হামাস প্রধান বলেন, একীভূত জেরুজালেম হলো আরব ও মুসলিমদের। এটা হলো ফিলিস্তিনি, সব ফিলিস্তিনির রাজধানী। এ সময় তিনি পশ্চিমাদের সমর্থন পাওয়া ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের প্রতি আহ্বান জানান ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিপ্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে। ট্রাম্প প্রশাসনকে বর্জনের আহ্বানও জানিয়ে ইসমাইল হানিয়া বলেন, এটা ঘোষণা করা যেতে পারে যে তথাকথিত শান্তি চুক্তির কবর রচিত হয়েছে। শান্তি চুক্তিতে অংশীদার ফিলিস্তিনি বলে আর কিছুই নেই।

বিশ্বজুড়ে নিন্দা-উদ্বেগ
ট্রাম্পের ঘোষণার আগে থেকে আরব ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো এবং মার্কিন মিত্ররা এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছিল। কিন্তু নিজ সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন ট্রাম্প। তাঁর ঘোষণার পর থেকে বিশ্বনেতারা নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ট্রাম্পের ঘোষণার সমালোচনা করে এই বলে সতর্ক করেছেন যে জেরুজালেমের কী হবে, তা কেবল ইসরায়েল-ফিলিস্তিন আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে আমি এখন থেকেই এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে আমার অবস্থানের কথা জানিয়ে যাব।’

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেছেন, তাঁর সরকার মার্কিন প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছে না। এটি মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি আলোচনার জন্য সহায়ক নয়।

ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। ট্রাম্পের ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যকে আগুনের কুণ্ডলীর মধ্যে ঠেলে দেবে বলে মন্তব্য তাঁর। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের নিন্দা করেছেন। এর বিরুদ্ধে মিছিলের ডাক দিয়েছেন তিনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সৌদি আরবের রাজকীয় আদালত এক বিবৃতিতে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে ‘অযৌক্তিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে মন্তব্য করেছে। ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক ও মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। ইরান ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেছে, এ সিদ্ধান্তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের নতুন উত্তেজনা শুরু হতে পারে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল তাঁর মুখপাত্রের মাধ্যমে জানিয়েছেন, দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ভঙ্গ করে ট্রাম্প যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা তিনি সমর্থন করেন না। ‘পৃথক দুই রাষ্ট্র’—এই নীতির মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান বলে তিনি মনে করেন।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের কার্যালয় থেকে ট্রাম্পের জেরুজালেম সিদ্ধান্তের নিন্দা জানানো হয়েছে। এক বিবৃতিতে তাঁর কার্যালয় থেকে বলা হয়, ‘জেরুজালেমের ভবিষ্যৎ কোনো রাষ্ট্র বা প্রেসিডেন্টের দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে না।’ লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের চাওয়া ও অধিকারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশ সময় গতকাল বুধবার রাত সোয়া ১২টার দিকে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জাতিসংঘ, আরব ও মুসলমান-অধ্যুষিত দেশ, এমনকি মার্কিন মিত্রদের আপত্তিকে পাত্তা না দিয়ে তিনি নিজের একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তেই অনড় থাকেন।

মার্কিন নিরাপত্তা হুমকিতে
ট্রাম্পের এ ঘোষণার আগে থেকে মার্কিন কর্তৃপক্ষ নিজের দেশের নাগরিকদের জেরুজালেমের ওল্ড সিটি এবং পশ্চিম তীর এড়িয়ে যেতে বলেছে। এখন বিভিন্ন দেশে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে হুমকি আসছে। ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ আল-নুজাবা ইরানের সমর্থনপুষ্ট। তারা বলছে, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। ফলে মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলা এখন বৈধ হয়ে উঠছে। লেবাননের সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ-সংশ্লিষ্ট একটি গণমাধ্যম ‘যুক্তরাষ্ট্রের মৃত্যু পরোয়ানা’ জারি করেছে।

দূতাবাস জেরুজালেমে নেওয়ার উদ্যোগ
বার্তা সংস্থা আইএএনএস জানিয়েছে, ইসরায়েলের মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ‘তাৎক্ষণিকভাবে’ কাজ শুরু করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। ট্রাম্পের ঘোষণার সময় টিলারসন ইউরোপ সফরে ছিলেন। সেখানে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ট্রাম্পের ঘোষণার আগেই পররাষ্ট্র দপ্তর বিভিন্ন বন্ধু, অংশীদার এবং মিত্রদেশের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করেছে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।