ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে কারচুপির শঙ্কা

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্য জনসভায় বলছেন, ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ এবারও হতে চলেছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসভাজন দলের সভাপতি অমিত শাহ। অমিত শাহ নিশ্চিতভাবেই দেড় শ আসন জিতে ষষ্ঠবারের মতো বিজেপির সরকার গড়ে দেবেন।

এ জন্যই কু গাইছে গুজরাটের বিরোধীদের মন এবং সাধারণ মানুষজনের একাংশ। সরাসরিই তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে কি অমিত শাহর দৌলতে গুজরাটের প্রকৃত নায়ক হতে চলেছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন, সংক্ষেপে যা ইভিএম নামে পরিচিত?

প্রায় এক সপ্তাহ ধরে রাজ্যটা ঘুরছি। দেখছি, গুজরাটের আনাচকানাচে কেন যেন এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের সাম্প্রতিক পৌরসভার ভোটে বিজেপির জয়জয়কারের পর। জনগণের একাংশের মনে কীভাবে যেন এই ধারণাটা ক্রমেই গেড়ে বসছে যে এত বিরোধিতা সত্ত্বেও শেষ বেলায় ইভিএমে কারচুপি করে বিজেপি ঠিক ম্যাচটা বের করে নিয়ে যাবে।

প্রচারটা যে ভারতের নির্বাচন কমিশনের কানে যায়নি, তা নয়। কমিশনও জানে, ভোটের আগে এমন প্রচার তাদের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার পক্ষে ভালো নয়। সেই কারণেই মুখ্য নির্বাচন কমিশনার অচল কুমার জ্যোতি দুদিনের জন্য গুজরাট ঘুরে গেলেন। সর্বদলীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে জানিয়ে গেলেন, নির্বাচনের দিন মানুষের সন্দেহ দূর করতে প্রতিটি কেন্দ্রের অন্তত একটি করে বুথের ইভিএম ও তার সঙ্গে ‘ভিভিপ্যাট’ মেশিন পরীক্ষা করা হবে। এই বুথ পছন্দ করা হবে আচমকাই, সব দলের প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে।

ইভিএমের সঙ্গে ‘ভিভিপ্যাট’ মেশিন যোগ করা হচ্ছে এবারই প্রথম। এর কারণও রয়েছে। অতীতে বেশ কয়েকবার ভোট গণনার পর বিরোধীরা ইভিএমে কারচুপির অভিযোগ এনেছেন। বলেছেন, যেখানেই বোতাম টেপা হোক, ভোট যাচ্ছে একটি প্রতীকে। সেটা করা হচ্ছে ইলেকট্রনিক মেশিনে কারচুপির মাধ্যমে। অভিযোগের অসাড়ত্ব প্রমাণ করতে নির্বাচন কমিশন সব রাজনৈতিক দলকে চ্যালেঞ্জও জানিয়েছিল। কিন্তু শর্তাধীন সেই পরীক্ষায় অনেক দলই রাজি হয়নি। অভিযোগ থেকেও সরে আসেনি।

এই কারণেই ‘ভিভিপ্যাট’ মেশিনের সংযুক্তি। পুরো নাম ‘ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেল’। ইভিএমে বোতাম টেপার সঙ্গে সঙ্গে ‘ভিভিপ্যাট’ মেশিন থেকে একটুকরো কাগজ বেরিয়ে আসবে। তাতে কোন প্রার্থীর প্রতীকে ভোটটা দেওয়া হলো, তা বলা থাকবে। কমিশন সেই কাগজের টুকরোগুলোর সঙ্গে ইভিএমে পড়া মোট ভোট মিলিয়ে দেখবে। কারও সন্দেহ হলে তৎক্ষণাৎ চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন।

বিরোধীরা কিন্তু এতেও স্বস্তিতে নেই। গুজরাটের সর্বত্র এমন একটা বিশ্বাস ছেয়ে যাচ্ছে যে শেষ পর্যন্ত এই কারচুপিটাই হতে চলেছে। অমিত শাহ পর্যন্ত এক জনসভায় এই কথাটা ঠাট্টার সঙ্গে বলে ফেলেছেন। বলেছেন, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বিরোধীরা লজ্জা ঢাকতে ওই ইভিএমেরই আশ্রয় নেবে। কারচুপির অভিযোগ আনবে। এ ছাড়া ওদের করার আর কিছুই থাকবে না।

কিন্তু কেন এত সন্দেহ? প্রথম কারণ, এই প্রথম ভারতের নির্বাচন কমিশনের তিন সদস্যকেই নরেন্দ্র মোদির সরকার নিযুক্তি দিয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, তিন সদস্যই বিজেপি-শাসিত রাজ্য গুজরাট, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের আমলা। তৃতীয় ও মোক্ষম কারণ, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার অচল কুমার জ্যোতি ছিলেন গুজরাটের সাবেক মুখ্য সচিব। নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন অচল কুমার জ্যোতি ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ। বাকি দুই কমিশনার সুনীল কুমার হলেন রাজস্থান ক্যাডার, ওমপ্রকাশ রাওয়াত মধ্যপ্রদেশের। তিন রাজ্যেই বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়।

গুজরাট ভোটের দিন ঘোষণায় বিলম্ব করার কারণে নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সমালোচিত। তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয়ও সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ভোটের আগেই জন্ম নিয়েছে ইভিএম নিয়ে সম্ভাব্য কারচুপির বিশ্বাস। অচল কুমার জ্যোতিরা যা নিরসন করতে পারছেন না।