ভিসার অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করতে পারবে দূতাবাস?

কাজের পর হামাদ স্ট্রিটে প্রবাসীদের আড্ডা l পেনিনসুলা
কাজের পর হামাদ স্ট্রিটে প্রবাসীদের আড্ডা l পেনিনসুলা

মুশাইরিব এলাকার বিখ্যাত বাংলা টাউন ‘ন্যাশনাল’ আর নেই। পুরোনো, সরু অলিগলির গোলকধাঁধা সরিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে আধুনিক মেট্রো রেলস্টেশন। নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। কিছুদিন পরেই এই এলাকা দিয়ে চলবে রেলগাড়ি। এই এলাকায় তখন শোনা যাবে ইঞ্জিনের শব্দ। স্টেশন ঘিরে গড়ে উঠবে অন্য একধরনের বসতি। রেলযাত্রীদের কোলাহল ছাপিয়ে আর শোনা যাবে না কারও উচ্চ স্বরের ডাক, ‘ও ভাই, বাড়ি যাচ্চু কবে?’ কিংবা ‘বদ্দা, গম আছনি?’ ইত্যাদি।

ন্যাশনালে বাংলাদেশিদের আড্ডা ভেঙে যাওয়ার পর মনে হয়েছিল, হয়তো যে যার পথে চলে যাবে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের এমন মিলনমেলা দোহা শহরে আর হয়তো জমে উঠবে না কখনো। কিন্তু বেশ কিছুদিন পরে লক্ষ করলাম, শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ ঘিরে উঁকি দিতে শুরু করেছে খণ্ডিত ন্যাশনাল। শিল্প এলাকার লেবার সিটি, এশিয়া টাউন কিংবা নাজমা বাদ দিলে মাইজার, ফারিজ বিন আবদুল আজিজ, সালাতা কাদিম, পুরোনো দোহা পেট্রল পাম্প এলাকায় বাংলাদেশিদের আসর এখন জমজমাট।
ফারিজ বিন আবদুল আজিজ এলাকায় প্রায় আট বছর আগে চালু হয় প্যারামাউন্ট রেস্তোরাঁ। ধীরে ধীরে এই রেস্তোরাঁ ঘিরে জমে উঠেছে বাঙালির আড্ডা। এই এলাকায় পরে চালু হয়েছে আরও চার-পাঁচটি রেস্তোরাঁ, সেলুন, কাঁচা মাংসের দোকান ও দেশি মুদিদোকান। মানিকপুর, দাগনভূঞা নামের এলাকাভিত্তিক রেস্তোরাঁ যেমন হয়েছে, তেমনি রয়েছে কাব্যিক নামের ‘দারুচিনি’ (গনির হোটেল) রেস্তোরাঁ। দেশ থেকে অভিজ্ঞ কারিগর এনে মানিকপুর রেস্তোরাঁ তৈরি করছে সুস্বাদু মিষ্টি। এদিকে সালাতা কাদিম এলাকার আক্কাছ সওদাগরের দোকান মুগলিনা ও সালাতা এলাকার অন্যতম আকর্ষণ বলা যায়।
ইদানীং দোহা শহরে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁর সংখ্যা হঠাৎ করে তিন–চার গুণ বেড়ে গেছে। কাতারে প্রবাসী বাংলাদেশি জনসংখ্যা গত তিন বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু এঁদের অধিকাংশ হলেন শ্রমিক, যাঁরা থাকেন শহর থেকে দূরে শ্রমিক ক্যাম্পে। কাতারের প্রবাসী জনসংখ্যা বাড়লেও দোহা শহরতলিতে বসবাসকারী বাঙালির সংখ্যা সেই হারে বাড়েনি। শ্রমিক ক্যাম্পে বসবাসরত বাংলাদেশি কর্মীরা সপ্তাহে কেবল এক দিন অর্থাৎ শুক্রবার শহরে আসার সুযোগ পান। এ ছাড়া শ্রমিক ক্যাম্পের আশপাশে যে হারে দোকানপাট গড়ে উঠেছে, তাতে তাঁদের আর শহরে আসার প্রয়োজন পড়ে না। তাই নতুন রেস্তোরাঁ করার আগে ভাবা উচিত, দোকানে বাড়তি ক্রেতা আসবে কোত্থেকে? 

কয়েকজন রেস্তোরাঁর মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁদের দুরবস্থার কথা। ৪০-৫০ হাজার রিয়াল ভাড়া দিয়ে খরচ তুলতেই তাঁদের নাভিশ্বাস উঠছে। তাই বেশ কিছু রেস্তোরাঁ বারবার হাতবদল হচ্ছে। নাজমার সুক হারেজ এলাকার কথাই ধরা যাক। কাতারে আসার পর কেবল চোখে পড়ত আলাউদ্দিন ও ইস্ট-ওয়েস্ট। এখন সেখানে আরও ডজনখানিক রেস্তোরাঁ দেখা যাচ্ছে!
ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য অন্যান্য কমিউনিটির মানুষকেও রেস্তোরাঁয় টানতে হবে। বাংলাদেশি রেস্তোরাঁগুলোর প্রধান সমস্যা হচ্ছে, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার অভাব। রেস্তোরাঁর পরিবেশন কর্মীদের মাথায় নেই টুপি, গায়ে নেই পরিচ্ছন্ন পোশাক। একটি মানসম্মত খাবারের দোকানের জন্য এগুলো আবশ্যক। ফলে খাবার মজাদার হলেও ভেতরের অনুন্নত পরিবেশের জন্য অন্যান্য কমিউনিটির বেশির ভাগ মানুষ বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ এড়িয়ে চলেন। এ জন্য রেস্তোরাঁর মালিকদের নিয়মিত বড় অঙ্কের জরিমানাও দিতে হচ্ছে। কিন্তু তারপরও রেস্তোরাঁর পরিবেশ উন্নয়নে তাঁদের তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায় না।
মুশাইরিব এলাকায় পুরোনো দোহা পেট্রল পাম্পের উল্টো দিকে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে চোখে পড়ে বাংলাদেশিদের বিশাল জমায়েত। সন্ধ্যা নামলে প্রায় প্রতিদিনই ওই এলাকার ফুটপাতে বসে যায় বাংলাবাজার। রাস্তায় বাতি নেই। তাতে কী? মুঠোফোনের আলোতেই চলে জমজমাট বাজার। দিনের শেষে মুশাইরিব নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চুকিয়ে মূলত শ্রমিকেরা ভিড় জমান এই বাজারে। ঝালমুড়ি, ফল, শাকসবজি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই মেলে এখানে? ক্যাম্পে যাওয়ার আগে যে যতটুকু পারেন, কিনে নিয়ে যান। সেখানে বিক্রি হয় ঝাল মুড়ি, সেদ্ধ ডিম, সরিষাবাটা, শুঁটকি ভর্তা দিয়ে গরম-গরম চিতই পিঠা। এদিকে ট্যাক্সিক্যাব চালকেরা বসে নেই। যাত্রী ভাড়া নিতে তাঁরাও ব্যতিব্যস্ত।
বাংলাদেশি কমিউনিটির এমনই একটি বাজার বসে শিল্প এলাকার ১৬ নম্বর রোডে। এই বাজারে চাল, শাকসবজি থেকে শুরু করে গরু ও খাসির মাংসও বিক্রি হয়। এই বাজারে গরুর মাংস ২৪ রিয়ালে বিক্রি হয়, যা সাধারণ কসাইয়ের দোকানের চেয়ে অনেক কম। পুলিশ অতীতে অনেকবার এই বাজার ভেঙে দিয়েছে। বেশ কিছু বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। তারপরও এই বাজার থামাতে পারেনি পুলিশ। কখনো মনে হয়েছে, সাধারণ মানুষের কিছুটা সুবিধার কথা ভেবে পুলিশ অনেক সময় এসব দেখেও না দেখার ভান করে।
এসব ভ্রাম্যমাণ বাজারের সমস্যা হচ্ছে, আপনি যদি ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকেন, তাহলে পড়তে পারেন চরম বিপাকে এবং ঠাঁই হতে পারে কারাগারে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর হলো, বাজারে অনেক মানুষের ভিড়ে বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ নেশাজাত দ্রব্য। জানা গেছে, অনেক বাংলাদেশি নিষিদ্ধ দ্রব্য বিক্রি ও সেবনের দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করছেন। সেখানে বসে দেশে ফেরার দিন গুনছেন। এ ধরনের অপরাধে কাতারে ছাড় পাওয়া বলতে গেলে অসম্ভব। তাই ধরা পড়লে দেশে ফিরে যেতেই হবে। এতে ব্যক্তির পাশাপাশি পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটির মুখে কালি পড়ে। নিষিদ্ধ পথে না গিয়ে বৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের বহু রাস্তা রয়েছে কাতারে।
মধ্যপ্রাচ্যে সহজে বড় অঙ্কের অর্থ আয়ের উপায় হচ্ছে ভিসা ব্যবসা। অধিকাংশ ব্যবসায়ী নিজস্ব ব্যবসা চালানোর জন্য মালিক থেকে কর্মচারী নিয়োগের জন্য কিছু ভিসা পান। তবে অনেক চতুর ব্যবসায়ী স্থানীয় কাতারিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে কিছু বাড়তি ভিসাও বের করেন। সেই ভিসা ২০-৩০ হাজার রিয়ালে বিক্রি করে রাতারাতি হয়ে যান কোটিপতি। দেখা যায়, ব্যবসায়িক আয়ের চেয়ে ভিসার লেনদেন করে তাঁরা অনেক বেশি আয় করতে পারেন। তাই অনেকে নামমাত্র ব্যবসার আড়ালে ভিসা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন।
এ ধরনের তথাকথিত ফ্রি ভিসায় যাঁরা আসছেন, তাঁদের অনেকেই প্রতারিত হচ্ছেন। কোম্পানির সঙ্গে একটা চুক্তিপত্র দেওয়া হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কাতারে আসার পর তাঁদের মূলত রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়। চুক্তিপত্রে বর্ণিত কোনো সুযোগ-সুবিধাই তাঁরা পান না। ফলে পেটের দায়ে এঁদের অনেকেই ধীরে ধীরে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। কিছুদিন আগে দোহার একটি আবাসিক এলাকায় দুই ডজনের মতো বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন কয়েকজন বাংলাদেশি। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ কমিউনিটিতে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই ‘ফ্রি’ ভিসা।
তবে সম্প্রতি শ্রম মন্ত্রণালয়ের একটি সিদ্ধান্ত ভিসা ব্যবসার অভিশাপ থেকে মুক্তির ক্ষীণ আলো দেখাচ্ছে। এখন থেকে কোনো কোম্পানি যদি জনশক্তি আনতে চায়, তাহলে কর্মচারীর সঙ্গে কোম্পানির চুক্তিপত্র কাতারে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম বিভাগ থেকে সত্যায়িত করে নিতে হবে। বাংলাদেশ দূতাবাস এই চুক্তিপত্রের শর্তাবলি আইনসম্মত কি না, তা যাচাই করে দেখবে। শুধু তা–ই নয়, কোম্পানির মান্দুব কিংবা কম্পিউটার কার্ডে স্বাক্ষর আছে সে রকম কোনো কর্মচারীকে দূতাবাসে এসে এই চুক্তিপত্র প্রত্যয়ন করে নিতে হবে।
দূতাবাস সূত্র জানায়, এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম বিভাগ বহুদিন ধরে ঢাকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়ে আসছিল। ভিসা ব্যবসায় অনিয়ম বন্ধে এটি একটি ভালো পদক্ষেপ। তবে দূতাবাসকে এ ক্ষেত্রে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন। অন্যথায় ইতিবাচক এই উদ্যোগ কোনো কাজেই আসবে না।
দূতাবাস ও জনশক্তি আমদানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, জনশক্তি আমদানিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা সুফল বয়ে আনবে। এই নতুন পদক্ষেপ ভিসা ব্যবসায়ীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে। ফলে ফাঁকি দিয়ে প্রতারণা করার আর সুযোগ থাকবে না। এর আগেও সবাইকে চুক্তিপত্র দেওয়া হতো। কিন্তু প্রবাসে আসার পর সেই চুক্তিপত্র এক টুকরো কাগজের মতো ছুড়ে ফেলা দেওয়া হতো। চুক্তির কোনো শর্তই মানা হতো না। যে বেতনের কথা বলা হতো, তার অর্ধেকও দেওয়া হতো না। থাকার জায়গা দেওয়া হবে বলা হলেও তার দেখা মিলত না। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা দূতাবাসে অভিযোগ করলেও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া সহজ ছিল না। এখন চুক্তিপত্রে কোম্পানির মালিকপক্ষের দায়বদ্ধতা থাকায় প্রতারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কোম্পানির বিরুদ্ধে দূতাবাস ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে।
ভিসা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, ইতিমধ্যে মাঠপর্যায়ে নতুন নিয়মের সুফল পাওয়া যাচ্ছে। যে ভিসা ২০ হাজার রিয়ালে বিক্রি হতো, তার মূল্য এখন তিন হাজারে নেমে এসেছে। শুধু তা–ই নয়, চুক্তিপত্র প্রত্যায়নের জন্য দেয় ফি থেকে দূতাবাস এবং সরকারের বাড়তি আয় হচ্ছে।
ভিসার নামে প্রতারণা মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিরও চরম ক্ষতি করছে, যার কুফল ভোগ করছে পুরো প্রবাসী জনগোষ্ঠী। যেসব বাংলাদেশি কাজের জন্য কাতারে আসছেন, এই পদক্ষেপ তাঁদের প্রতারকদের হাত থেকে রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখবে। এ কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশা করছেন, সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন ফ্রি ভিসার দৌরাত্ম্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। প্রবাসে স্বদেশের ভাবমূর্তি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
(লেখক: প্রকৌশলী ও গবেষক)